Image description
বাজেট ২০২৫-২৬। করপোরেট করের শর্ত শিথিল হচ্ছে ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে এবারও রাজস্ব আয় বাড়াতে সহজ পথেই হাঁটছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটেও করহার বাড়িয়ে রাজস্ব লক্ষ্য অর্জনের ছক আঁকছে সংস্থাটি। এরই ধারাবাহিকতায় টার্নওভার কর বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হচ্ছে। ব্যবসায় লোকসান করলেও এই কর দিতে হয়। অন্যদিকে এবার করপোরেট কর কমছে না। তবে শর্ত শিথিল করা হচ্ছে। যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শর্তের কারণে কর ছাড়ের সুবিধা পায় না কেউই। দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক লেনদেনের ওপর টার্নওভার কর বা ন্যূনতম কর আরোপ করা হয়। ব্যবসায় লাভ-ক্ষতি নির্বিশেষে এই কর আদায় করা হয়। ব্যবসায় লোকসান হলেও এ কর ব্যবসায়ীদের দিতে হয়। ন্যূনতম করকে আয়কর আইনের মূলনীতির পরিপন্থি আখ্যা দিয়ে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে। বর্তমানে যেসব ব্যবসায় বছরে তিন কোটি টাকা বা এর বেশি টার্নওভার রয়েছে, তার ওপর শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ ন্যূনতম কর আরোপিত আছে। তবে পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত শিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদন শুরুর পরবর্তী প্রথম ৩ বছর ন্যূনতম করহার দশমিক ১০ শতাংশ। এর বাইরে মোবাইল অপারেটরদের লাভ-ক্ষতি নির্বিশেষে টার্নওভারের ওপর ২ শতাংশ, তামাক প্রস্তুতকারক সিগারেট কোম্পানির ন্যূনতম করহার ৩ শতাংশ এবং কার্বোনেটেড বেভারেজ উৎপাদকদের করহার ৩ শতাংশ।

আয়কর কর্মকর্তাদের মতে, করপোরেট করদাতারা প্রায়ই নানা উপায়ে এবং অজুহাতে কর দেন না অথবা কম কর দেন। এছাড়াও বিভিন্ন অব্যাহতি ও রেয়াতের সুযোগ নেন। ব্যবসায় লোকসান দেখিয়ে অনেক ব্যবসায়ী আয়কর দিতে চান না। আবার অনেকে আয় কম দেখিয়ে সামান্য কর দেন। তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের জন্য এই ধারা আয়কর আইনে যুক্ত করা হয়েছে। এতে অনেক প্রতিষ্ঠান কর দিতে বাধ্য হচ্ছে।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, আগামী বাজেটে ন্যূনতম করহার দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে এক শতাংশ করা হচ্ছে। মোবাইল অপারেটর ও সিগারেট, বিড়ি, চুষে খাওয়ার তামাক, ধোঁয়াবিহীন তামাক বা অন্য সব তামাক প্রস্তুতকারক কোম্পানির ন্যূনতম কর আগের মতোই থাকছে। এ বিষয়ে হিসাববিদ ও আয়কর বিশেষজ্ঞ লুৎফুল হাদি বলেন, টার্নওভার ট্যাক্স আয়করের মূলনীতির পরিপন্থি। তারপরও এনবিআর যেহেতু রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে ন্যূনতম কর আরোপ করছে, সেহেতু এটি আরও সহনীয় করা উচিত। টার্নওভার কর বাড়ানো হলে ব্যবসার মূলধন সংকুচিত হবে। তখন ব্যবসায়ীদের মধ্যে কর এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। টার্নওভার ট্যাক্স বাড়ানো হলেও এনবিআরের উচিত সমন্বয় করা বা ক্যারি ফরোয়ার্ডের সুযোগ রাখা। এতে কিছুটা হলেও ব্যবসায়ীরা স্বস্তি পেতে পারে।

অন্যদিকে করপোরেট কর ছাড়ের সুবিধা পেতে নগদ লেনদেনের শর্ত শিথিল করা হতে পারে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতিতে নগদ লেনদেনের পরিমাণ কমিয়ে আনতে শর্তজুড়ে দিয়ে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়। শর্ত দেওয়া হয়-এ সুযোগ নিতে হলে কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই সব ধরনের প্রাপ্তি ও আয় ব্যাংক স্থানান্তরের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে নগদ লেনদেনের সীমা বছরে ১২ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অবশ্য পরবর্তীতে ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে এই সীমা বাড়িয়ে ৩৬ লাখ টাকা এবং একক লেনদেনের সীমা ৫ লাখ টাকা করা হয়। গত কয়েক অর্থবছরের বাজেটে ধারাবাহিকভাবে করপোরেট কর কমানো হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে করপোরেট কর ছিল ৩৫ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে এটি কমিয়ে ৩২.৫ শতাংশ, ২০২১-২২-এ ৩০ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শর্তসাপেক্ষে করপোরেট কর ২৭.৫ শতাংশ এবং সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শর্তসাপেক্ষে করহার ২৫ শতাংশ করা হয়।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে করপোরেট করহার কমানো হবে না। তবে শর্তের সীমায় ছাড় দেওয়া হবে। এখন নগদ লেনদেনের সীমা ৩৬ লাখ টাকা আছে, এটি বাড়িয়ে ৫০ লাখ টাকা করা হচ্ছে।

শিল্পমালিকরা বলছেন, করপোরেট কর কমানো হলেও শিল্প সেই সুফল ভোগ করতে পারবে না। কারণ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অনানুষ্ঠানিক খাতের (ইনফরমাল ইকোনমি) প্রভাব বেশি। বহুজাতিক কমপ্লায়েন্স প্রতিষ্ঠানও এনবিআরের শর্ত পূরণ করতে পারছে না। তাই কর হ্রাসের সুবিধা শিল্প ভোগ করতে পারবে না। শিল্পকে সহায়তা করতে চাইলে শর্তহীনভাবে কর কমাতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশের কোনো কোম্পানির পক্ষে বর্তমান শর্ত পূরণ করার মাধ্যমে কর হ্রাসের সুবিধা নেওয়া সম্ভব নয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যবসার ধরন ভেদে করপোরেট করহারের তারতম্য রয়েছে। যেমন শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির দুই ধরনের করহার আছে। কোনো কোম্পানি তার পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তর করলে করহার হবে ২০ শতাংশ। ১০ শতাংশের কম হস্তান্তর করলে করহার ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে লেনদেনের শর্ত মানতে না পারলে এর সঙ্গে আরও আড়াই শতাংশ যোগ হয়। সাধারণ কোম্পানির করহার শর্ত মানলে ২৫ শতাংশ, শর্ত মানতে ব্যর্থ হলে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এক ব্যক্তির কোম্পানির করহার শর্ত মানলে ২০ শতাংশ, শর্ত না মানতে পারলে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ।

অন্যদিকে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করহার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ, তালিকাবহির্ভূত এ ধরনের কোম্পানির করহার ৪০ শতাংশ। মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তামাকজাত পণ্য যেমন সিগারেট, বিড়ি, জর্দা ও গুলের করহার ৪৫ শতাংশ। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত মোবাইল অপারেটরের করহার ৪০ শতাংশ, তালিকাবহির্ভূত এ ধরনের কোম্পানির করহার ৪৫ শতাংশ। সমবায় সমিতির করহার ২০ শতাংশ।