Image description
বেজমেন্টে গ্যারেজের স্থলে সিলিন্ডার ও জেনারেটর

ঢাকার বেইলি রোডের ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টার। ভবনটিতে প্রতিদিনের মতো ছিল মানুষের সমাগম। পরিবার-পরিজন, বন্ধুদের নিয়ে এই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে কেনাকাটা ও রেস্টুরেন্টে খেতে যেতেন সব বয়সী মানুষ। শিশুরা মেতে উঠতো সেখানে থাকা বাবুল্যান্ডে। তবে ভবনটি ঘিরে এখন বিরাজ করছে ভয় ও আতঙ্ক। সোমবার এই বহুতল ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। দিনে রৌদ্রের প্রখরতা শেষে সন্ধ্যা নামার পরে বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠে ভবনটি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় চারপাশ। জীবন বাঁচাতে ক্রেতা-বিক্রেতারা ছুটতে থাকেন দিগ্বিদিক। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ভবনের ছাদে আশ্রয় নেয়া নারী-পুরুষ ও শিশুদের উদ্ধার করেন। প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ফায়ার সার্ভিস বলছে, বেজমেন্টে গাড়ির গ্যারেজ থাকার কথা, কিন্তু ছিল সিলিন্ডার ও জেনারেটর। জেনারেটর থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। ভবনের সামনে নিরাপত্তায় রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

গতকাল সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টার নামের ওই ভবনের বিভিন্ন তলায় পোশাক, প্রসাধনীসহ বিভিন্ন জিনিসের দোকান রয়েছে। ভবনটির সামনের দিকের একপাশে কালো ধোঁয়ার আস্তরণ পড়েছে। অনেকে দেখার জন্য ছুটে এসেছেন সেখানে। ব্যবসায়ীরা ভবনটির কার্যক্রম বন্ধ থাকায়  আশপাশে ঘুরছেন। কোনো কোনো দোকানের মধ্যে কালো ধোঁয়া প্রবেশ করে দোকানে থাকা জিনিসপত্র কালো হয়ে গেছে। কেউ কেউ ভেতরে প্রবেশ করে তাদের সেই জিনিসপত্র বের করে বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন। 
আগুনের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে গাড়িচালক শাহজাহান মানবজমিনকে বলেন, এই মার্কেটে আমার মালিকের ফটোকপি-স্টুডিওর তিনটি দোকান রয়েছে। ঘটনার আগে আমি দোকানের মালিককে নামিয়ে মাত্র পার্কিংয়ে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করি। এ সময় ট্রান্সমিটার ব্লাস্ট হয়ে আগুন ও ধোঁয়া দেখা যায়, তখন আমি বাইরে বেরিয়ে আসি। এরপর উপরে থাকা আমার মালিককে ফোন দেই। সবাই ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কোনোভাবে আগুনটি ভেতরে গেলে সব শেষ হয়ে যেতো। ভবনের বেজমেন্টে জেনারেটর রয়েছে। ভবনের নিচে ক্ষতি হয়েছে কিন্তু ভেতরে কোনো ক্ষতি হয়নি। আমাকে বের হতে দেখে সেখানে আরও অনেকে বেরিয়ে আসে। মার্কেটের অনেকে জীবনবাজি রেখে আগুন নেভানোর কাজ করেছে। ফায়ার সার্ভিস খবর পেয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে চলে এসেছে। ভবনের মধ্যে যদি কোনোভাবে আগুন লাগতো তাহলে পুরো শেষ হয়ে যেতো। ভবনটির দশতলা পর্যন্ত বর্তমানে চালু রয়েছে। উপরের তলাগুলোতে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। এখানে রেস্টুরেন্ট, প্রসাধনী, পোশাকের দোকান রয়েছে। ২০০-২৫০টির মতো দোকান রয়েছে। বর্তমানে মার্কেটটি বন্ধ রয়েছে। কিছু ক্ষতি হয়েছে সেগুলো  মেরামত না করা পর্যন্ত খুলবে না। গত বছরে গ্রিন কোজি কটেজে লাগা আগুনের মতো ভয়ে ছিল সবাই।

সাবরিনা নামে এক নারী দোকানি বলেন, এখনো আতঙ্ক কাটছে না। যখন আগুনের কথা শুনি তখন বাইরে বেরিয়ে আসি। এ সময় জিনিসের মায়া করিনি, জীবন বাঁচাতে বাইরে বেরিয়ে আসি। আমার দোকানের কোনো ক্ষতি হয়নি।

ব্যবসায়ী নাজিম বলেন, তিনতলায় আমার কাপড় ও টেইলার্সের দোকান রয়েছে। জিনিসপত্র ধোঁয়ায় কালো হয়ে রয়েছে। পুরো দোকান দেখার মতো নেই, কালো হয়ে আছে। সকালে দোকানের মধ্যে গিয়ে এরকম দেখে কিছু কাপড় নিয়ে বাসায় যাচ্ছি। এক সপ্তাহের মতো বন্ধ থাকতে পারে মার্কেট। ঘটনার সময় ভেতরে ছিলাম তখন বিকট একটা আওয়াজ শুনতে পাই। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চলে যায়। ধোঁয়ায় কালো হয়ে গিয়েছিল তখন। এরমধ্যে উপরে চলে যাই। নিচে নামতে গিয়ে দেখি নামা যাচ্ছে না। শুধু দিকবিদিক ছুটাছুটি করেছি। একপর্যায়ে বাইরে বেরিয়ে আসি।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেনেন্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে রাত ৭টা ৪৭ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হই। ভবনটিতে শপিংমল, রেস্টুরেন্ট, হোটেল, অফিস ও আবাসিক ফ্ল্যাট ছিল। হুইল চেয়ারেও রেস্টুরেন্ট কিংবা উপরে গিয়েছিলেন আমরা দেখেছি। প্রায় দুইশ’র কাছাকাছি পরিবারের সদস্য ছিল। প্রায় একশ’র কাছাকাছি মানুষকে আমরা উপর থেকে নামিয়ে নিরাপদে নিয়ে আসি। পাশেই বেইলি রোডের একটি পুকুর থাকায় পুকুরের পানি নিয়ে আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে বেজমেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে মনে হয়েছে। তদন্তের পর আগুনের মূল কারণ জানা যাবে। তিনি বলেন, বেজমেন্টে গাড়ির গ্যারেজ হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা সিলিন্ডার ও জেনারেটর দেখেছি। জেনারেটরের পয়েন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাতটা বেশি দেখছি। অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে শুরুতে আমাদের কাজ করতে বেগ পেতে হয়েছে। ৫-৬ তলা পর্যন্ত ধোঁয়া ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, জেনারেটর থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। এ ঘটনায় আহত কিংবা নিহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

উল্লেখ্য, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৭ মিনিটে ঢাকার বেইলি রোডের ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টার আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। এরপর ৭টা ৪৭ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। 

গত বছরের ২৯শে ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুপুরী এই ভবনটি এখনো ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় রয়েছে। সোমবার আবার বেইলি রোডের বহুতল ভবনে আগুন লাগার পর আশপাশের মানুষের মধ্যে সেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।