Image description

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) বিভিন্ন প্রকল্পের অনুমোদন, বাস্তবায়ন ও তদারকির ক্ষেত্রে অনিয়ম ও আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটের। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এলজিইডির বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। এই সিন্ডিকেট প্রকল্পের অনুমোদন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন ও বিল পরিশোধ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।

দুদকের সাম্প্রতিক অভিযানে এলজিইডির বিভিন্ন দপ্তর থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে।

দুদকের একটি সূত্র জানিয়েছে, তাদের হাতে এলজিইডির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য-প্রমাণ রয়েছে এবং শিগগিরই তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হতে পারে।

এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মতিউর রহমান বলেন, আগে রাজনৈতিক চাপ ছিল। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে কাজ করা যায়নি। উন্নয়নকাজের ক্ষেত্রে যদি রাজনৈতিক কোনো চাপ না থাকে, তাহলে এলজিইডি ভালোভাবে কাজ করতে পারবে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর দেশে যত অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে, তা এই এলজিইডিই করেছে। কিন্তু গত দেড় যুগে এর ব্যত্যয় ঘটেছে শুধু রাজনৈতিক কারণে। আশা করছি, এলজিইডি ভবিষ্যতে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারবে।

দুদকের অভিযানে অনিয়মের যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন স্তরে গভীর সংকট তৈরি করেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সড়ক ও সেতু নির্মাণ এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। এতে কাজের গুণগত মান ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।উদ্বেগজনক বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রে নতুন করে নির্মিত রাস্তা অল্প সময়ের মধ্যেই ভেঙে যাচ্ছে, যা প্রকল্পের স্থায়িত্ব নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে।

দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, অযৌক্তিক কারণে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি এবং সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে এবং জনগণ প্রত্যাশিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ অনুমোদন ছাড়াই প্রকল্পের কাজ শুরু করে অনিয়ম ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক প্রকল্পে সঠিকভাবে তদারকি না করার কারণে ঠিকাদাররা নিম্নমানের কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম জানান, দুদকের কর্মকর্তারা এলজিইডি কার্যালয়ে গিয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করেছেন। এসব তথ্যের ভিত্তিতে তাঁরা দুদকের প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করবেন এবং এই প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এলজিইডির কয়েকজন কর্মকর্তা বলছেন, কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন নেই। এর অর্থ হলো, প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথাযথ সমীক্ষা ও প্রয়োজন নির্ধারণে ঘাটতি ছিল অথবা অনুমোদনপ্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা ছিল। যার ফলে অকার্যকর বা ভুয়া প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে।

আরিফুল ইসলাম নামে এলজিইডির তালিকাভুক্ত এক ঠিকাদার জানান, কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা থাকলে কাজ শুরু না করেই বা নামমাত্র কাজ দেখিয়ে বিল পরিশোধের মতো ঘটনা ঘটার সুযোগ থাকত না। কর্মকর্তাদের যোগসাজশ প্রমাণিত হওয়ার পরও যদি দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে অন্যরাও একই কাজ করতে উৎসাহিত হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করতে হলে হিসাবরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। এলজিইডির ভেতরে একটি সংগঠিত দুর্নীতির চক্র সক্রিয়। তারা একে অপরকে সাহায্য করে নিয়মিতভাবে অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে।

এলজিইডি প্রধান কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু সালেহ মো. হানিফ বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ এলজিইডির প্রধান কার্যালয় থেকে তদারক করা হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের তথ্যের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। সেখান থেকে কোনো ভুল তথ্য এলে আমাদের তো কিছু করার থাকে না।

পিরোজপুরে ব্যাপক দুর্নীতি : সম্প্র্রতি এই জেলার উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা এলজিইডির অভ্যন্তরে জোরালো ঝাঁকুনি দিয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকার দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে এবং দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিল পরিশোধের চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে, যা শুধু পিরোজপুর নয়, পুরো এলজিইডিকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এ ঘটনায় এর মধ্যে আটটি মামলা করেছে দুদক। এলজিইডি ও হিসাবরক্ষণ অফিসের কর্মকর্তাসহ ২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, পিরোজপুর জেলায় গত তিন বছরে এলজিইডির ১৬টি প্রকল্পের বিভিন্ন কাজ হবে বলে টাকা বরাদ্দ নেওয়া হয়। জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে সড়ক, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণে। দক্ষিণাঞ্চলে লোহার সেতু পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পে এই জেলায় ব্যয় হয়েছে ৭৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। কিন্তু ৪৯৪ কোটি ১৬ লাখ টাকার কাজের হিসাব পাওয়া গেছে; বাকি ২৬৩ কোটি ৭১ লাখ টাকার কাজের কোনো হিসাব নেই। এই কাজ কোথায় হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কি না, এর কোনো নথিই নেই পিরোজপুর জেলা এলজিইডির কার্যালয়ে।