
‘শীর্ষ সন্ত্রাসীর সহযোগী পরিচয়ে অর্ধকোটি টাকা চাঁদা চেয়ে আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। টাকা না দিলে পরিবারের কাউকে ছাড়বে না বলে শাসিয়েছে। আমার বাড়িতে এসে দুই দফায় গুলি করেছে। আতঙ্কে পরিবার নিয়ে আমি এখন অনেকটা ঘরবন্দি।
গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠের কাছে এভাবে নিজের এই দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন আবাসন ব্যবসায়ী মনির হোসেন। তিনি মোহাম্মদপুর চন্দ্রিমা হাউজিং লিমিটেডের পরিচালক। গত ২৮ এপ্রিল চাঁদার দাবিতে শেরশাহ শূরি রোডে তাঁর বাসার গ্যারেজে ঢুকে গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে মোটরসাইকেলে আসা দুই সন্ত্রাসী। এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়েছে। এ ব্যাপারে মনির হোসেন বলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। কারো কোনো ক্ষতিও কখনো করিনি। হত্যার হুমকিতে এখন ঘর থেকে বেরোতে পারছি না।’ মামলার তদন্তে পুলিশ অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) খোরশেদ আলম বলেন, ব্যবসায়ী মনিরকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে হুমকি দেওয়া হয়। এক মাস আগেও একবার তাঁকে হুমকি দিয়ে গুলির ঘটনায় জাবেদ নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনার একটি ভিডিও এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
শুধু ব্যবসায়ী মনিরের ঘটনা নয়, রাজধানীতে সম্প্রতি এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা ও চাঁদাবাজির ঘটনা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে শীর্ষ ছয় সন্ত্রাসী বিভিন্ন মামলায় জামিনে বেরিয়ে আসার পর এসব অপতৎপরতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েছে।
তথ্য রয়েছে, ২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ঘোষণা করে। তাঁদের মধ্যে ছয় শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাগার থেকে বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। সবাই ১৫-২০ বছর জেল খেটেছেন।
পুলিশ বলছে, মোহাম্মদপুর এলাকায় উঠতি সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়েছে। তাদের বেশির ভাগই কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের সদস্য।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার এ কে এম মেহেদী হাসান বলেন, ‘মোহাম্মদপুরে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তথ্য পাওয়া গেছে। আমরা এরই মধ্যে অভিযান চালিয়ে অনেক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছি।’
ব্যবসায়ী মনিরের বাসায় হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁর বাসার গ্যারেজে ঢুকে ফের গুলি করেছে সন্ত্রাসীরা। এতে কেউ হতাহত হয়নি। এক মাস আগে ২৪ মার্চ একই ব্যবসায়ীর বাসায় ঢুকে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে। দুটি ঘটনারই তদন্ত চলছে।
গত ১৯ এপ্রিল হাতিরঝিলে আরিফ সিকদার নামে রাজধানীর যুবদলের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন।
আরিফ হত্যা মামলার এজাহারনামীয় আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী শ্যুটার মাহফুজুর রহমান বিপুকে গত শুক্রবার গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। র্যাব জানায়, হাতিরঝিল ও মগবাজার এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও তাঁর সহযোগী বিপুর সহযোগীদের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে এলাকার সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ।
গ্রেপ্তার বিপুর বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় অস্ত্র মামলা (পরোয়ানাভুক্ত) এবং হাতিরঝিল থানায় হত্যাসহ চারটি মামলা রয়েছে। পুলিশের তথ্য মতে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও জিসান গ্রুপের বিরোধে যুবদল নেতা আরিফকে হত্যা করা হয়।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সহস্রাধিক সদস্য রয়েছে। তাঁদের বেশির ভাগই এখনো অধরা। তাঁরাই মূলত চাঁদাবাজি ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত।
ডিবি সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী দুবাইপ্রবাসী মশিউর রহমান মশি গ্রুপের হুদা মামুন, অরিন ও সোহেলের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে মিরপুরের পল্লবী এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ১১ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত মিল্লাত বিহারি ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে পর পর তিন দিন গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে।
জামিনে যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী : জামিনে মুক্তি পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে রয়েছেন হাজারীবাগ এলাকার সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন, কিলার আব্বাস হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী, মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালসহ ঢাকার অপরাধজগতের আরো দুই সদস্য খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পূর্ব রাজাবাজার এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম ১৯৯৭ সালে গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে ২২টি মামলার মধ্যে তেজগাঁও এলাকায় গালিব হত্যা মামলা রয়েছে। রাসুর বিরুদ্ধে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাসহ ১৩টি মামলা রয়েছে। পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে চারটি হত্যা মামলাসহ আটটি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় ২ নম্বরে টিটনের নাম রয়েছে। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার একটি বাসা থেকে ডিবি একটি পিস্তলসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
গত ১৩ আগস্ট কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান কিলার আব্বাস। রাজধানীর কাফরুল, কচুক্ষেত ও ইব্রাহিমপুর এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন ছিলেন আব্বাস। তাঁর বিরুদ্ধে ছয়টি হত্যা মামলাসহ ১০টি মামলা বিচারাধীন। তবে এই ১০টি মামলায় একে একে তিনি জামিন পান।
এর মধ্যে কাশিমপুর কারাগার থেকে বের হয়ে গুলশান এলাকার একটি বাসায় ওঠেন কিলার আব্বাস। তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন মিরপুর এলাকার অনেক রাজনৈতিক ও চিহ্নিত অপরাধী। কারাগার থেকে সহযোগীদের মাধ্যমে তিনি এলাকার আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন বলে ডিবি সূত্রে জানা যায়।
শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন জামিন পেয়ে মালয়েশিয়া চলে যান। তিনি দেশে ফিরেছেন, না মালয়েশিয়াতেই আছেন, বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এ ছাড়া আরো দুজন শীর্ষ সন্ত্রাসী দেশ ছেড়েছেন বলে গোয়েন্দা সূত্র জানায়।
জিসান দীর্ঘদিন ধরে মতিঝিল, রামপুরাসহ আরো কয়েকটি এলাকায় ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজি করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মতিঝিল এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, জিসান তাঁর সহযোগী দিয়ে তাঁর কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে। পুলিশকে জানালে তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য মতে, জামিনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এরই মধ্যে অনেক ব্যবসায়ীকে চাঁদার জন্য হুমকি দিয়েছেন। দখলবাজিতে বাধা পেয়ে এক সাংবাদিককে হত্যা করেছেন। এসব সন্ত্রাসী তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন গণ-অভ্যুখানের সময় কারাগার থেকে পালানো অন্তত ৭০০ আসামি।
যশোরে এক মতবিনিময়সভায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
ডিএমপি কমিশনার যা বলছেন : শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন বাতিলের আবদন করা হবে বলে জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ‘সুব্রত বাইন, সানজিদুল ইসলাম ইমন ও কিলার আব্বাসের মতো তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে পুলিশ। এত বছর জেল খেটেও নিজেদের তারা সংশোধন করেনি। তারা এমনভাবে চাঁদাবাজি ও গ্যাং তৎপরতা চালাচ্ছে, যেন কিছুই বদলায়নি।’