
ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের রংপুর বিভাগীয় অফিসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল কাদের বীর আজকের পত্রিকাকে বলেন , গ্রাহকদের টাকা পরিশোধে বিমা কোম্পানিটির দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকা সম্পত্তি বিক্রির জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও তা কেউ কিনতে সাড়া দেননি । তাই গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করা যাচ্ছে না । শুধু রংপুর নয় , সারা দেশে ২ লাখ ৪৩ হাজার গ্রাহকের ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পাওনা আছে । কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ( সিইও ) শহিদুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ গত ১২ বছর কোম্পানি লোপাট হয়েছে । ফলে গ্রাহকের বিমা দাবি দেওয়া সম্ভব হয়নি । আমি কিছুদিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি । তার পর থেকে ২০০ কোটি টাকা বিমা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে । গ্রাহকের টাকা পরিশোধের জন্য একটি পরিকল্পনা নিয়েছি , আস্তে আস্তে পরিশোধ করব । ”
রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন , ২০০০ সালে ইসলামি মনোভাবাপন্ন লোকদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড । ২০০৯ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর জামায়াতপন্থী ও বিএনপিপন্থী পরিচালনা পর্ষদকে হটিয়ে প্রতিষ্ঠান দখলে নেয় আওয়ামীপন্থীরা । ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এস আলম গ্রুপের অধীনে প্রতিষ্ঠানটিতে লুটপাট চলে । ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সালমান এফ রহমান প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি দখলে নেন । এরপর এর অবস্থা আরও করুণ হয়ে যায় ৷
গত বছরের ৫ আগস্টের পর সরকার পরিবর্তন হলে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন । মো . ফখরুল ইসলাম । বর্তমানে আর্থিক সংকটের কারণে গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না কোম্পানিটি । তবে দুই বছরের মধ্যে টাকা পরিশোধ করবে বলে জানান কর্মকর্তারা । ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ে গত সোমবার বিকেলে কথা হয় মুদিদোকানি মো . আলমের সঙ্গে । তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ আগে দোকান করে খেতাম । এখন বয়স হয়েছে , কিছু করতে পারি না । বৃদ্ধ বয়সে যাতে ভালো করে চলতে পারি , তাই বিমা করেছিলাম । কষ্ট করে না খেয়ে ১০ হাজার করে টাকা দিতাম । কিন্তু ১২ বছর শেষ হয়েছে তিন বছর আগে । তখন থেকে টাকার জন্য ঘুরছি । টাকা দিচ্ছে না । আজ বলল , আরও এক বছর সময় লাগবে । তত দিন বাঁচব কি না আল্লাহ জানে ।
বিমা কোম্পানিটির রংপুর বিভাগীয় কার্যালয় সূত্র বলেছে , এই বিভাগে দুই লাখের বেশি গ্রাহক রয়েছে তাদের । ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রংপুরের ৮ জেলার ২৯ হাজার ৫৯৬ জন গ্রাহকের বিমার মেয়াদ শেষ হয়েছে । বিমার বিপরীতে তাঁরা ১২০ কোটি ৯৭ লাখ ১১ হাজার ৪১৩ টাকা পাবেন । বিমা খাতের নিয়ম অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে গ্রাহকদের বিমার দাবি করা টাকা পরিশোধ করতে হবে । কিন্তু কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নানা অজুহাতে গ্রাহকদের ঘোরাচ্ছে । গ্রাহকদের অভিযোগ , তাঁরা বারবার কোম্পানির প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন কার্যালয়ে যোগাযোগ করে কেবল আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতিই পাচ্ছেন , টাকা আর পাচ্ছেন না । গ্রাহকদের কেউ কেউ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান ।
২০২২ সালে ১২ বছর মেয়াদি বিমার মেয়াদ শেষ হয়েছে গঙ্গাচড়া উপজেলার রাশেদা বেগমের । তিনিও তিন বছর ঘুরে আজ পর্যন্ত টাকা পাননি । সোমবার সেই টাকার খোঁজে ছেলে রাশেদুজ্জামানকে নিয়ে বিমা কোম্পানিটির বিভাগীয় কার্যালয়ে গেলে ঢাকায় যাওয়ার সুপারিশপত্র হাতে ধরিয়ে দেন কর্মকর্তারা । রাশেদুজ্জামান বলেন , ‘ মা অনেক কষ্ট করে এখানে টাকা জমিয়েছে । জমানো টাকা তুলে যাতে কোনো কিছু করতে পারে । কিন্তু তিন বছর ধরে টাকা দিচ্ছে না । শুধু আশ্বাস দিচ্ছে , টাকা পাব । কিন্তু কবে পাব , তা বলে না । কিছুদিন আগে জমি বিক্রি করে টাকা দিতে চেয়েছিল । এখন ঢাকায় যেতে বলছে । আমরা কী করব বুঝতে পারছি না । ' নগরীর রঘুর বাজার এলাকার প্রতিবন্ধী মোরশেদ আলম ১০ বছর ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সে টাকা জমিয়েছেন । মুনাফা তো দূরের কথা ,, এখন মূলধনটাও পাচ্ছেন না তিনি ।
মোরশেদ আলম বলেন , ‘২০২৩ সালে আমার বিমার মেয়াদ শেষ হইছে । দুই বছর ধরি ঘুরাচ্ছে , কিন্তু আমার টাকা দিচ্ছে না । শুধু বলে , তোমার টাকা মার যাবে না । ব্যাংক দেউলিয়া হয় , বিমা দেউলিয়া হয় না । আমার কষ্টের টাকাটা কি পাব ? ” ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের রংপুর বিভাগীয় অফিসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল কাদের বীর আজকের পত্রিকাকে বলেন , ' ব্যাংকে যে ডিপোজিট , এফডিআর ছিল , সেগুলো বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেনি । জমি কেনাবেচাসহ নানা দুর্নীতি করেছেন আগের মালিকেরা । সেই দুর্নীতির ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে গ্রাহকদের । গ্রাহকদের চাপ বাড়ায় আমরা ঢাকায় যোগাযোগ করেছি । মালিকপক্ষ বলেছে , তারা প্রতিষ্ঠান পেয়েছে , টাকা পায়নি । কারও টাকা মার যাবে না । সময় লাগবে দুই বছর । ’