Image description
বাংলাদেশ রেলওয়ে » দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কেনা হয়েছে ২০ টি লোকোমোটিভ ও ১৪৭ টি যাত্রীবাহী কোচ । অনেক কোচের ডিসপ্লে , অ্যামপ্লিফায়ার , কাপলার , ভলিউম কন্ট্রোলার এখন অকার্যকর । তিনটি পাওয়ার কার অকেজো । ২০ টি ইঞ্জিন , ৫৮ টি কোচের ওয়ারেন্টি পিরিয়ড শেষ ।
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ৬৫৮ কোটি টাকায় কেনা ডিজেলচালিত ২০ টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ ( ইঞ্জিন ) এবং ১৪৭ টি যাত্রীবাহী কোচের বেশ কয়েকটিতে কারিগরি ত্রুটি দেখা দিয়েছে । এগুলোর ডিসপ্লে কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে । ঘোষণা শুনতে পাচ্ছে না যাত্রীরা । এ কারণে ডিসপ্লে , পিআইএস , কাপলার প্রতিস্থাপনের বিকল্প নেই । অকেজো পড়ে আছে তিনটি পাওয়ার কার । বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র বলছে , চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ( ওয়ারেন্টির মেয়াদকালে ) ) কোরীয় ঠিকাদারের ত্রুটি মেরামত করার কথা ।
 
কিন্তু প্রকল্প দপ্তর , কোরীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি ও কোরীয় প্রতিনিধিকে জানানো হলেও কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় সমস্যা জটিল হয়েছে । চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ , রক্ষণাবেক্ষণ ও অপারেশনের জন্য সার্কিট ডায়াগ্রাম , ম্যানুয়াল , প্রোডাক্ট ব্রুশিয়ারের হার্ড কপি এবং সফট কপি সরবরাহ করা হয়নি । তবে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বলছে , রেলওয়ে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না করায় সমস্যা হয়েছে । এর আগে কিছু ত্রুটি ঠিকাদারের কাছ থেকে ঠিক করিয়ে নেওয়া হয় । ঠিকাদারকে ঢালাও দায় দেওয়া যাবে না । এখনকার সমস্যাগুলো কারিগরি কমিটির মাধ্যমে যথাযথভাবে প্রকল্প দপ্তরে এলে এবং ওয়ারেন্টির মেয়াদ থাকলে ঠিকাদারের কাছ থেকে ঠিক করিয়ে নেওয়া যাবে । দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কেনা ২০ টি লোকোমোটিভ ও ১৪৭ টি কোচ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে চলাচল করছে ।
 
রেলের পূর্বাঞ্চলের সূত্র জানায় , এসব কোচ ও ইঞ্জিনে বিভিন্ন কারিগরি ত্রুটি দেখা দিয়েছে । বিশেষ করে কোচের ডিসপ্লে , অ্যামপ্লিফায়ার , কাপলার ও ভলিউম অকার্যকর হয়ে পড়েছে । খোঁজ নিয়ে জানা গেছে , ২০১৭ সালে রেলওয়ে একটি প্রকল্পের আওতায় এসব ইঞ্জিন এবং কোচ কেনে । আটটি ধাপে এসব কোচ - ইঞ্জিন দেশে আসে । ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি এসেছিল প্রথম চালান এবং শেষ অর্থাৎ অষ্টম চালান আসে ২০২৪ সালের ১৭ এপ্রিল ।
কোচগুলো বাংলাদেশে সরবরাহের সময় বিশ্লেষণ করে দেখা যায় , ২০ টি লোকোমোটিভ এবং ৫৮ টি কোচের ওয়ারেন্টি পিরিয়ড ( দুই বছর ) শেষ হয়ে গেছে । বাকি ৮৯ টির ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মেয়াদ ধাপে ধাপে শেষ হবে ২০২৬ সালের ১৭ এপ্রিল নাগাদ । এই প্রকল্পে ৬৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ের ৭৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অর্থায়ন করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার এক্সপোর্ট - ইমপোর্ট ব্যাংকের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল ( ইডিসিএফ ) । বাকি ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ অর্থায়ন বাংলাদেশ সরকারের । ঠিকাদার দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ কোম্পানি সুংশিন আরএসটি-পসকো ইন্টারন্যাশনাল । এই প্রকল্পে কিছু টাকা সাশ্রয় হওয়ায় একই প্রতিষ্ঠান থেকে আরও ৩৫ টি কোচ কিনছে বাংলাদেশ রেলওয়ে । অবশ্য এর একটিও এখনো দেশে আসেনি ।
 
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন , কোরিয়ার কোচগুলোয় একাধিক কারিগরি সমস্যা দেখা দিয়েছে । বিষয়টি একাধিকবার লিখিত ও মৌখিকভাবে জানানো হলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি । বর্তমানে সমস্যা আরও জটিল হয়েছে । কোচগুলোর ডিসপ্লে ও পাবলিক অ্যাড্রেস ( পিএ ) ব্যবস্থা কার্যত অকার্যকর রয়েছে । ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি ও কোরিয়ান প্রতিনিধিকে বিষয়টি অবহিত করা হলেও এখনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি । রেলওয়ে সূত্র জানায় , ৭০৩ ( মহানগর গোধূলী ) / ৭৪২ ( তূর্ণা নিশীথা ) , ৭৪১ ( তূর্ণা নিশীথা ) / ৭০৪ ( মহানগর প্রভাতী ) , ৭৮৭ ( সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ) / ৭৮৮ ( সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ) নম্বর ট্রেনের ডিসপ্লের পাবলিক ইনফরমেশন সিস্টেম ( পিআইএস ) কন্ট্রোলার অকার্যকর হয়ে আছে । পিআইএস কন্ট্রোলার নতুন লাগানো ছাড়া ডিসপ্লে সিস্টেম কার্যকর করা যাবে না । পিআইএস কন্ট্রোলারের জন্য আপডেট সফটওয়্যার দিতে হবে । সফটওয়্যার দেওয়া হয়নি অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে কোচভিত্তিক নম্বর ইনপুট দেওয়ার জন্য কোনো ডিভাইস এবং নেটওয়ার্ক কেব্‌ল দেওয়া হয়নি । ঠিকাদারকে ডিসপ্লের সফটওয়্যার আপডেট দিতে বলা হলেও সেটি করছে না ।

( সুবর্ণ এক্সপ্রেস ) / ৭০২ ( সুবর্ণ এক্সপ্রেস ) , ৭০৩/৭৪২ , ৭৪১/৭০৪ নম্বর ট্রেনের উভয় দিকের অ্যামপ্লিফায়ার ( সাউন্ড রেগুলেটর ) অকার্যকর হয়ে গেছে । ৭৮৭/৭৮৮ নম্বর ট্রেনের শুধু এক দিকের অ্যামপ্লিফায়ার কার্যকর । এতে প্রায়ই অ্যামপ্লিফায়ার বন্ধ হয়ে যায় । আপৎকালের জন্য স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা অ্যামপ্লিফায়ার দিয়ে পিএ সিস্টেম সচল রাখা হয় । সূত্র জানায় , কোরীয় কোচগুলোর ৪০ টি কাপলার অকার্যকর রয়েছে । এগুলো বদলে কার্যকর কাপলার সরবরাহ করা না হলে কোনোভাবে ট্রেনগুলোর ডিসপ্লে সিস্টেম সচল করা সম্ভব নয় । কাপলারের মাধ্যমে ট্রেনের দরজার কন্ট্রোল এবং যাত্রীদের তথ্য দেওয়ার ব্যবস্থা পরিচালিত হয় । কাপলারে মোট ৩৮ টি পিন থাকে । যেকোনো একটি পিন নষ্ট হলে বা পানি ঢুকলে বা শর্টসার্কিট হলে , এমনকি ভারী কুয়াশা হলেও পিএ ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে সব ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।

এ ছাড়া ৭০১/৭০২ , ৭০৩/৭৪২ , ৭৪১/৭০৪ , ৭৮৭/৭৮৮ নম্বর ট্রেনের ১৩১ টি ভলিউম কন্ট্রোলার অকার্যকর হয়ে পড়েছে । এ বিষয়ে ইতিপূর্বে জানানো হলেও ভলিউম কন্ট্রোলার প্রতিস্থাপন করা হয়নি । এ কারণে যাত্রীরা ট্রেনে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা যথাযথভাবে শুনতে পায় না । প্রতি কোচে দুটি সিসিটিভি ক্যামেরা ও একটি এনজিআর স্থাপন করা হয়েছে । কিন্তু ভিডিও চিত্র দেখার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি । ফলে সিসিটিভি ক্যামেরা কার্যকর কি না , তা বোঝা যায় না । রেলের পূর্বাঞ্চলের কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে , কোরিয়ার পাওয়ার কারের জেনারেটর ১৫ টির বেশি কোচের লোড নিতে পারে না । তাই এসব পাওয়ার কারে সর্বোচ্চ ১৫ টি কোচ সংযুক্ত করা যায় । এই পাওয়ার কারে ঈদের সময় বাড়তি কোচ যুক্ত করা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে । বর্তমানে তিনটি পাওয়ার কার অকেজো পড়ে আছে । কোচের এসব ত্রুটির বিষয়ে জানতে চাইলে ২০ লোকোমোটিভ ও ১৫০ মিটারগেজ যাত্রী কোচ সংগ্রহ প্রকল্পের পরিচালক ফকির মো . মহিউদ্দীন আজকের পত্রিকাকে বলেন , নতুন কোচের এসব সমস্যা যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে হয়েছে । এসব কোচ যেভাবে রক্ষণাবেক্ষণ দরকার ছিল , সেভাবে হয়নি । কোচের কাপলারগুলো খুলে রাখায় সেগুলোয় পানি ঢুকে সমস্যা হয়েছে । এর আগেও কিছু সমস্যা হয়েছিল , ঠিকাদারের কাছ থেকে সেসব ঠিক করিয়ে নেওয়া হয় । তবে এখন যে সমস্যাগুলোর কথা বলা হচ্ছে , এগুলোর জন্য কারিগরি কমিটির মাধ্যমে যথাযথভাবে এই দপ্তরে এলে , ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মধ্যে এবং চুক্তিতে থাকলে ঠিকাদারের কাছ থেকে নেওয়া যাবে । তবে ঠিকাদারকে ঢালাও দায় দেওয়া যাবে না ।

এসব কোচ ও ইঞ্জিন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রেলের বিভিন্ন বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা আজকের পত্রিকাকে জানান , প্রকল্পে উল্লেখ আছে রক্ষণাবেক্ষণের মেয়াদ ২ বছর । রক্ষণাবেক্ষণ মেয়াদে ত্রুটি দেখা দিলে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে ঠিক করতে হবে অর্থাৎ ঠিকাদার করে দেবে । ঠিকাদার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করছে না । সেটার দায় রেলের ওপর চাপাতে চাইছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ । নিম্নমানের সরঞ্জাম সরবরাহ করায় সমস্যা হচ্ছে । কাপলার ট্রেনের বাইরের অংশে থাকে , সেগুলো রোদ - বৃষ্টিতে এত দ্রুত নষ্ট হবে কেন ? প্রকল্প দপ্তর সূত্র বলছে , চুক্তি অনুযায়ী কোচ দেশে আসার সময় থেকে পরবর্তী দুই বছর প্রতিটি কোচ ও ইঞ্জিনের ওয়ারেন্টি পিরিয়ড । অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে কোনো সমস্যা হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঠিক করে দেবে । তবে রেলের কর্মীদের ভুলে সমস্যা তৈরি হলে এর দায় ঠিকাদার নেবে না । কারিগরি ত্রুটি হলে ঠিকাদার দেখবে । রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন , যেসব কোচের সমস্যা হয়েছে , সেগুলো ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মধ্যেই আছে । এরপরও সেগুলোর ত্রুটি সারাচ্ছে না ঠিকাদার । দৃষ্টি আকর্ষণ করলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ( বুয়েট ) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো . হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন , কোরিয়া থেকে কোচ - ইঞ্জিন আনার আগে কি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়েছিল ? এমন কোচ অন্য যেসব দেশ কিনেছে , তাদের এত দ্রুত সমস্যা হয়েছে কি না , এগুলো চিন্তা না করেই ক্রয় কমিটির কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া ভুল হয়েছে । রেলে কোচ - ইঞ্জিনের যে সংকট , তাতে এত কোটি টাকার একটি প্রকল্পে এমন সমস্যা যদি হতে থাকে , তাহলে ভবিষ্যতে এসব কোচের দশা ডেমুর মতো হওয়ার আশঙ্কা থাকে ।