
দেশে প্রতিদিন এক কোটিরও বেশি আন্তর্জাতিক ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) এসএমএস আসে। মাইক্রোসফট, গুগল, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবহারকারীদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় এসব এসএমএস পাঠায়। কিন্তু এত বিশালসংখ্যক এসএমএস আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা বা সরকার নির্ধারিত ফি কাঠামো না থাকায় হাজার কোটি টাকা লোপাট করছে দেশের মোবাইল অপারেটররা। এর ফলে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। তৈরি হয়েছে অর্থ পাচারের সুগম পথ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটররা (এমএনও) প্রতিটি আন্তর্জাতিক এসএমএস (শর্ট মেসেজ সার্ভিস)-এর বিপরীতে গড়ে ২৫ টাকা হারে আয় করছে। সে হিসাবে এই খাতে প্রতিদিন প্রায় পঁচিশ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। বছরে এই অঙ্ক নয় হাজার একশ পঁচিশ কোটি টাকারও বেশি। যা পুরোপুরি সরকারের রাজস্ব কাঠামোর বাইরে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই লেনদেন সম্পন্ন হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায়। বিশেষ করে ডলার ও ইউরোতে। এর ফলে দেশের টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বর্তমানে এই খাতটি এক ধরনের ‘গ্রে এরিয়া’ হিসাবে পরিচালিত হচ্ছে। বিটিআরসির পক্ষ থেকে নেই কোনো নির্ধারিত এসএমএস টার্মিনেশন রেট, নেই বাধ্যতামূলক রিপোর্টিং সিস্টেম। ফলে একাধিক অপারেটর গ্রে রুট ব্যবহার করে এসএমএস আদান-প্রদান করছে। যা সাইবার নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। বর্তমানে মোবাইল অপারেটররা সরাসরি বা সাব-অপারেটরের মাধ্যমে এসএমএস টার্মিনেশন সার্ভিস দিয়ে থাকে। এসব প্রক্রিয়া বিটিআরসি মনিটর বা লাইসেন্সভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ করে না। ফলে একদিকে অপারেটররা নির্বিঘ্নে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে, অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মহলের চাপে দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক এসএমএস খাতে নীতিমালা প্রণয়নে আগ্রহ দেখায়নি বিটিআরসি। শুধু মোবাইল অপারেটরদের দেওয়া তথ্যেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘সন্তুষ্ট’ থেকেছে। ফলে কোনো ধরনের জবাবদিহি ছাড়াই এই খাতটি পরিচালিত হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাব ও লেনদেনের হিসাবেই দীর্ঘদিন ধরে এ খাতকে বিবেচনা করা হয়। যা অর্থ পাচার ও ডলারের অনিয়ন্ত্রিত লেনদেনের ঝুঁকি তৈরি করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘যেহেতু এসব এসএমএস আন্তর্জাতিক উৎস থেকে আসে এবং ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়, এগুলোর ওপর নির্দিষ্ট টার্মিনেশন ফি ধার্য করাই যৌক্তিক। ভারত, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, এমনকি আফ্রিকার অনেক দেশও আন্তর্জাতিক এসএমএসের জন্য আলাদা চার্জ নিয়ে থাকে। অনেক দেশেই এসএমএসের জন্য স্পষ্ট ফি কাঠামো ও নিয়ন্ত্রিত গেটওয়ে চালু রয়েছে। বাংলাদেশ এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক লাইসেন্সিং বা মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করতে পারেনি। এতে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা রয়েছে।’
একজন সাবেক মোবাইল অপারেটর কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, সরকার এখনো আন্তর্জাতিক এসএমএস গেটওয়ের জন্য নির্দিষ্ট কোনো লাইসেন্স বা নীতিমালা চালু করেনি। এই শূন্যতার সুযোগে মোবাইল অপারেটররা গোপনে বিদেশি এসএমএস, বিশেষ করে ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড (OTP) ভিত্তিক বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করছে। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে এবং এই খাতের ওপর কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিদিন এক কোটির বেশি আন্তর্জাতিক এসএমএস দেশে ব্যবহারকারীদের কাছে ডেলিভারি হলেও এর স্বচ্ছ হিসাব নেই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছেও এই খাতের কোনো হিসাব নেই বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। বিদেশ থেকে আসা কোটি কোটি টাকা মূল্যের এসএমএস পেমেন্ট ব্যাংকিং চ্যানেল বাইপাস করায় তা মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ তৈরি করছে।
প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) পক্ষ থেকে সরকারের ন্যয্য হিস্যা আদায় ও আন্তর্জাতিক এসএমএসের সুস্পষ্ট নীতিমালা চেয়ে সম্প্রতি চিঠির মাধ্যমে বিটিআরসিকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘যেহেতু মোবাইল অপারেটররা কত সংখ্যক আন্তর্জাতিক এসএমএস আসে কিংবা এই খাত থেকে কত টাকা আয় হয় তা প্রকাশ করে না। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রবেশ করছে না। বরং এই খাতে অর্থ পাচারের আশঙ্কা বাড়ছে। বিটিআরসি এ বিষয়ে গাইডলাইন না দিলেও, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রাজস্ব বিভাগ অপারেটরদের কাছে হিসাব চাইতে পারে। যথাযথ তদন্ত ও ব্যবস্থা না নিলে এসএমএস খাতের অনিয়ম দূর করা সম্ভব নয়’-বলেন তিনি।
গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশনস আংকিত সুরেকা বলেন, ‘গ্রামীণফোন সব সময় দেশের প্রচলিত আইন ও বিধিনিষেধ মেনে, স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। আমরা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সিদ্ধান্তকে সম্মান করি এবং বিশ্বাস করি। টেলিকম খাতের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের (এমএনও) সঙ্গে যথাযথ পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা তাইমুর রহমান জানান, আন্তর্জাতিক ওটিপি এসএমএস সেবা টেন্ডারের মাধ্যমে নির্বাচিত অংশীদারদের দিয়ে পরিচালিত হয়। এসব অংশীদার আন্তর্জাতিক সার্ভিস প্রভাইডারের কাছ থেকে এসএমএস পেয়ে ফায়ারওয়ালের মাধ্যমে ফিল্টার করে বাংলালিংকের নেটওয়ার্কে পাঠায়। এ খাত থেকে কত এসএমএস আসে, সে বিষয়ে তথ্য প্রকাশযোগ্য নয় জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের নির্ধারিত টার্মিনেশন রেট বা গেটওয়ে চালু হলে তা ব্যবসার প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবন কমিয়ে ফেলতে পারে।
আরেক মোবাইল অপারেটর রবির কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা লিখিতভাবে প্রশ্ন পাঠাতে অনুরোধ করেন। লিখিত প্রশ্ন পাঠানোর পর ৩ দিন অপেক্ষা করিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কোনো বক্তব্য না দিয়ে ‘কোনো মন্তব্য নেই’ বলে জানিয়ে দেয়। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক এসএমএস খাতে যে অনিয়ম চলছে, তা কোনোভাবেই নীতিনির্ধারকদের অজানা থাকার কথা নয়। এখানে স্পষ্টতই অর্থ পাচার হচ্ছে। ‘এই খাতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকার সুযোগে মোবাইল অপারেটররা বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। বিগত সরকার একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দিতেই নীতিমালা করেনি, সেটা পরিষ্কার। গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় নীতিমালা তৈরিতে উদাসীনতা দেখানো হয়েছে।’ এখনই প্রয়োজন, সংশ্লিষ্টদের শনাক্ত করে স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে জবাবদিহির আওতায় আনা, যাতে রাষ্ট্রের স্বার্থ ও সুশাসন নিশ্চিত হয়।’
বিটিআরসির চেয়ারম্যান এমদাদুল বারী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। গাইডলাইন কবে নাগাদ আসবে এ বিষয়ে এখনই কিছু বলাটা সময়োপযোগী হবে না। তবে সরকার আন্তরিকভাবে চায় এই খাতটি কাঠামোবদ্ধ হোক।’
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী প্রকৌশলী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রযুক্তি খাতে যে লুকায়িত অর্থনৈতিক লিকেজ রয়েছে, তা বন্ধে সরকার এখন অত্যন্ত সক্রিয়। আন্তর্জাতিক এসএমএসের মাধ্যমে যেন কোনোভাবেই অর্থ পাচার না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে অচিরেই কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। সরকার এখানে রাজস্ব হারাচ্ছে-এটা ঠিক। এই খাতকে সুশাসনের আওতায় আনতে আমরা প্রাইসিং এবং ট্যারিফ নীতিমালা প্রণয়ন করে টেন্ডারের মাধ্যমে এগ্রিগেটর নিয়োগ করব, যাতে নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা যায় এবং সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় থাকে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি নির্দিষ্ট এসএমএস টার্মিনেশন চার্জ ও গেটওয়ে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা চালু করলে সরকার প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে পারবে। একই সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং আন্তর্জাতিক বার্তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।