Image description
রাখাইনের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার । জাতিসংঘের প্রস্তাবে ঢাকার নীতিগত সম্মতি । রাখাইনে ত্রাণ দিলে সুফল পাবে আরাকান আর্মি । ঝুঁকির বিষয়টি পর্যালোচনা করা জরুরি -মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের ।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ পৌঁছাতে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। মিয়ানমারের রাজ্যটিতে আরাকান আর্মির উত্থানে সীমান্তে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে মানবিক করিডর দেওয়া নিয়ে সর্বত্র চলছে নানা বিতর্ক। জাতিসংঘের অনুরোধে এ ধরনের করিডর দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হলেও বাংলাদেশের জন্যে ঝুঁকির আশঙ্কাও আছে।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, মানবিক করিডর দিতে নীতিগত সম্মত হলেও কিছু শর্ত রয়েছে। তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু না বললেও আশঙ্কা করা হচ্ছে-এমন করিডরের মাধ্যমে মূলত মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি লাভবান হবে। ফলে মিয়ানমারের সরকার এর প্রতিবাদ জানাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র স্বস্তিবোধ করলেও চীনের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। ফলে ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় নিতে বলছেন অনেকে। আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বিশেষ করে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের পুরো সীমান্তে রাখাইন অংশে দেশটির সামরিক জান্তার সেনাবাহিনী তাতমান্ডু পরাস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে এখন আরাকান আর্মির শক্ত অবস্থান। তবে সশস্ত্র গ্রুপটির অবস্থান শক্তিশালী হলেও তাদের খাদ্যসহ রসদসামগ্রীর সংকট দেখা দিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মিকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ত্রাণ দিতে চায় জাতিসংঘ। বিশ্ব সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে রাখাইন রাজ্যে খাদ্য সংকটে ত্রাণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। জাতিসংঘের প্রস্তাবিত এই মানবিক করিডরের ব্যাপারে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানোর পরই শুরু হয়েছে বিতর্ক। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এ কথা স্বীকার করেছে যে, আরাকান আর্মির সঙ্গে ‘অনানুষ্ঠানিক’ যোগাযোগ করা হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আমরা আরেকটা গাজায় পরিণত হতে চাই না। আরাকানদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য হিম্যানেটারিয়ান প্যাসেজ নিয়ে ইউনূস সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে সরকারের সে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল।’

সম্প্রতি বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি নামক স্থানে, যা মিয়ানমার সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের ১০ কিলোমিটার ভেতরে, আরাকান আর্মির সদস্যরা স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায়ের সঙ্গে জলকেলি উৎসবে যোগ দিলে বাংলাদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। রেমাক্রি অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি স্থান। সেখানে জলপ্রপাত আছে। বান্দরবানে মিয়ানমার সীমান্ত রেমাক্রির খুব কাছে। এই দিক দিয়ে রাখাইন আর্মির বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ প্রায়ই ঘটে বলে জানা যায়। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এ ঘটনার কড়া সমালোচনা করে অবিলম্বে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানায়। আরাকান আর্মির অবাধ চলাচলের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মুখে স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আরাকান আর্মির অনুপ্রবেশ সম্পর্কে যা কিছু বলা হচ্ছে, এর পুরোটাই সত্য নয়। আবার পুরোটাই মিথ্যাও নয়। আরাকান আর্মির সদস্যরা বাংলাদেশে বিয়ে পর্যন্ত করে ফেলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে আমদানির জন্য বাংলাদেশিদের দুই জায়গায় ট্যাক্স দিতে হয়। সিতওয়েতে মিয়ানমার সরকারকে আবার নাফ নদীর কাছে আরাকান আর্মিকে ট্যাক্স দিতে হয়।’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এমন স্বীকারোক্তির পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন আরও স্পষ্ট করেন, ‘আরাকান আর্মি একটি নন স্টেট অ্যাক্টর। ফলে সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির কোনো আলোচনা হয়নি। তবে মাঠ পর্যায়ে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রয়েছে বলে অফিশিয়ালি স্বীকার করে নিচ্ছি। আরাকান আর্মি সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমত, এর সঙ্গে আমাদের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি তো পরে; কিন্তু তাদের অভ্যন্তরীণ সংঘাত তো আমাদের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। মিয়ানমারের একটা বিরাট জনগোষ্ঠী তো আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়ে আছে এবং তাদের আমরা ফেরত পাঠাতে চাই। কাজেই সেই ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে আমাদের যা কিছু করার প্রয়োজন, সেটা তো আমাদের করতে হবে। কারণ, আমাদের স্বার্থ সেখানে সংশ্লিষ্ট। এ কথা আমরা অফিশিয়ালিও বলছি যে, বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্ত পরিস্থিতিতে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এটা তো অস্বীকার করতে পারব না।’ এভাবে তিনি আরাকান আর্মি যে এখন একটা বাস্তবতা, সেটা স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের পছন্দ করে না।

যুক্তরাষ্ট্রও আরাকান আর্মিকে মানবিক করিডরে ত্রাণ দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাব সমর্থন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে পাশ হওয়া বার্মা অ্যাক্টের মূল কথা হলো, যারাই মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র মারণাস্ত্র নয় (নন লেথাল)-এমন সহায়তা দেওয়াকে উৎসাহিত করবে। মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের একজন জেনারেল, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পূর্ব এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি এবং মিয়ানমারে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরকালে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে বাংলাদেশের তরফে কিছুই বলা হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, আমার জিনিস থেকে কিংবা জাতিসংঘের সহায়তা আমি পৌঁছে দিচ্ছি কি না আরাকানে-আমি তো আরাকানের বর্ডার পর্যন্ত দিতেই পারি। আমার নিরাপত্তা বাহিনী আরাকানে ঢুকবে কি না, সেট স্পষ্টভাবে বলতে হবে। এখান থেকে জাতিসংঘ যদি যেতে চায় এবং আরাকান আর্মি যদি রাজি থাকে, এটা নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী ওই জাতিসংঘের কর্মীদের নিরাপত্তায় জাড়িত কি না, সেট নিয়েই জটিলতা।

আরাকান আর্মি কারা : মিয়ানমারের বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন রাখাইন রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন সম্প্রদায়ের সশস্ত্র গ্রুপ হলো আরাকান আর্মি। বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) সামরিক উইং হলো আরাকান আর্মি। ২০০৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মির (কেআইএ) কাছে তারা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। ২০১৯ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকান আর্মি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ২০২০ সালে তারা যুদ্ধবিরতি করে। তবে কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে রাখাইনে ক্ষমতার শূন্যস্থান দখল করে আরাকান আর্মি। মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। আরাকান আর্মি যুদ্ধবিরতি লংঘন করলে জান্তার বাহিনী আরাকান আর্মির ওপর বিমান হামলা শুরু করে। তার মধ্যেও আরাকান আর্মি গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে ঠান্ডু, মংডুসহ একের পর এক শহর দখলে নেয়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আরাকান আর্মি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পুরোটাই দখলে নিয়ে নেয়। আরাকান আর্মির সৈন্য সংখ্যা ৪৫ হাজার। মিয়ানমারের সরকার আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে অভিহিত করেছে। যদিও আরাকান আর্মি স্বাধীনতা চায়নি। তারা অবাধ স্বায়ত্তশাসন চায়।

রোহিঙ্গাবিরোধী : আরাকান আর্মি বৌদ্ধ ধর্মের রাখাইন জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠন। মিয়ানমারের সাধারণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যেমন সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ঘৃণা করে; আরাকান আর্মিও এর ব্যতিক্রম নয়। রোহিঙ্গাদের দমন-পীড়নের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ করার অভিযোগ আরাকান আর্মির বিরুদ্ধেও রয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের মানব ঢাল হিসাবেও ব্যবহার করেছে। বিভিন্ন রোহিঙ্গা গ্রুপের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। অনেক রোহিঙ্গাকে তাদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের বাঙালি মৌলবাদী বলেও বিভিন্ন সময়ে আখ্যায়িত করেছে। তবে একপর্যায়ে আরাকান আর্মির একজন মুখপাত্র রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনায় প্রস্তুত বলেও জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়।

বিদেশি সমর্থন : ভারতের তরফে একবার দাবি করা হয়, আরাকান আর্মি চীনের সমর্থনপুষ্ট। তারা চীনের অস্ত্র ব্যবহার করে। ভারত প্রাথমিকভাবে মিয়ানমারের জান্তার সমর্থক হলেও পরবর্তী সময়ে রাখাইন রাজ্যের ওপর নেওয়া কালাদান মাল্টিমুডাল প্রকল্পকে অক্ষত রাখতে আরাকান আর্মির সঙ্গেও যোগাযোগ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গোষ্ঠী জাতিসংঘের মাধ্যমে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টি করছে।