
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে চলা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে হামলার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাবির টিএসসি সংলগ্ন সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের সামনে এ হামলায় দুই শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছেন। তারা হলেন ঢাবির আরবি বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের খালেদ হাসান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের সানি সরকার।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা ১১টার পর থেকেই টিএসসি চত্বরে জমায়েত হতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বিকেলের ‘মার্চ ফর প্যালেস্টাইন’ কর্মসূচির প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বটতলায় তারা ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, পতাকা তৈরি করছিলেন। একপর্যায়ে কিছু লোক রাজু ভাস্কর্যে কালো পতাকা লাগাতে গেলে এক শিক্ষার্থী বাধা দেন। পরে উত্তেজিত জনতা তাকে ‘ইসলামবিদ্বেষী’ বলে মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে উত্তেজিত জনতা ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সানি সরকারের ওপর চড়াও হয়। হামলার শিকার হন তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যাওয়া অন্য শিক্ষার্থীরাও।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ঘটনাস্থলে উপস্থিত ৫০ থেকে ৬০ জনের একটি দল ‘ইসলামবিদ্বেষী’ তকমা দিয়ে হামলায় অংশ নেয়। ব্যাপক মারধরের শিকার হন খালেদ হাসান ও সানি সরকার। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে তাদের ঢাবির শহীদ বুদ্ধিজীবী মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারে রাখা হয়েছে। সানির মাথায় সিটিস্ক্যান ও এক্স-রে করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি আশঙ্কামুক্ত হলেও শারীরিকভাবে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
এদিকে হামলায় জড়িতদের মধ্যে মূল ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা গেছে। তিনি ঢাবির পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রায়ান। থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে। রায়ান নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীরের অন্যতম সংগঠক বলে নিশ্চিত হয়েছে কালবেলা।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের (বাগছাস) ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের কালবেলাকে বলেন, ‘আমি আর মাহিন সাড়ে ১১টার দিকে টিএসসিতে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় খেয়াল করলাম, নটরডেম কলেজের পোশাক পরা চার শিক্ষার্থী কপালে ও হাতে কালো পতাকা নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যাচ্ছেন। তখন আমি তাদের বুঝিয়ে বলার পর তারা সেগুলো খুলে ফেলেন। পরে আবার খেয়াল করলাম কালো পতাকা হাতে মাইকের কাছে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন। তারা কালো পতাকা উড়াচ্ছেন।’
কাদের আরও বলেন, ‘তখন আমরা তাদের যখন বোঝাতে গেছি যে আপনারা এই পতাকা নামিয়ে ফেলেন; এগুলো ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। তখন অভিযুক্তসহ (রায়ান) তিন থেকে চারজন চিল্লাচিল্লি শুরু করে এই বলে, আমরা নাকি ইসলামবিরোধী। আমাদের মারার জন্য উপস্থিত সবাইকে উসকে দেন তারা। পরে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকরা আমাকে টিএসসির ভেতরে নিয়ে যান। না হলে আমাকেও মারধর করা হতো।’
সূত্র জানায়, রায়ানের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীর। ৫ আগস্টের পরে ঢাবি ক্যাম্পাসে হিজবুত তাহরীর যেসব কর্মসূচি পালন করেছে, সেগুলোয় সরব ছিলেন তিনি।
রায়ানের এক বন্ধু কালবেলাকে বলেন, ‘রায়ান দীর্ঘদিন ধরে হিজবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত। ক্যাম্পাসে ওদের যত প্রোগ্রাম হয় সব জায়গায় রায়ান থাকে। মূলত সে এর অন্যতম সংগঠক হিসেবে কাজ করে।’ এ বিষয় বক্তব্য নিতে রায়ানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে, হামলার ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা মামলা করবেন বলে জানা গেছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ ঘটনা অবহিত করা হলেও তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে (সিরিয়াসলি) দেখছি। হিজবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত থাকার যে অভিযোগ আসছে, আমরা সেগুলো আরও যাচাই-বাছাই করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এখানে কাজ করছে। সবকিছু জেনে তদন্তসাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রক্টরিয়াল টিম নিষ্ক্রিয় ছিল—শিক্ষার্থীদের এমন অভিযোগের জবাবে প্রক্টর বলেন, ‘সেখানে শত শত মানুষ ছিল। এখানে কোনো কিছু করতে গেলে ভেবেচিন্তে করতে হয়। তারা ভূমিকা রেখেছে। নিবৃত থাকেনি।’
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলা করবে না বলে জানান প্রক্টর। তবে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা যদি মামলা করেন, সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের যথাযথ সহযোগিতা করবে।