
পতিত আওয়ামী লীগ সরকার অবৈধ উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনসাধারণের ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহার করে পুলিশকে। উচ্চাভিলাষী অপেশাদার ও অতিউৎসাহী পুলিশ সদস্যদের বিধিবহির্ভূত বলপ্রয়োগের ফলে প্রাণ হারান অসংখ্য মানুষ। ফলে জুলাই বিপ্লবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল পুলিশ ও পুলিশের স্থাপনা। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের পুলিশি ব্যবস্থা। ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগ সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়িত হওয়ায় অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে পুলিশ বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও আশানুরূপ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ অবস্থায় পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জুলাই বিপ্লবে পুলিশ বাহিনীর ওপর জনরোষ ও বিপর্যয়ের কারণগুলো অনুসন্ধান করছেন। আগামী ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য পুলিশ সপ্তাহের মধ্যে বিপর্যয়ের কারণগুলো নির্ণয় করে সেগুলো প্রতিকার ও সমাধানের পথ খুঁজছেন তারা। সামগ্রিকভাবে কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি ইউনিটভিত্তিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খোঁজা হচ্ছে। যাতে ভবিষ্যতে পুলিশ এ জাতীয় বিপর্যয় এড়িয়ে চলতে পারে। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবে পুলিশ কেন এত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটার কারণগুলো আমরা চিহ্নিত করছি। আমরা পর্যবেক্ষণে দেখেছি যে, বিগত সরকারের সময়ে পুলিশে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার দুই ধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই বড় ধরনের ত্রুটি ছিল। রাজনৈতিক বিবেচনায় ও সুপারিশে নিয়োগ দিয়ে পুলিশে পেশাদারিত্ব ধ্বংস করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষা ও বিএসএস-পরবর্তী প্রশিক্ষণেও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে অনেক মেধাবী প্রার্থী রাজনৈতিক কারণে বাদ পড়েছেন। রাজনৈতিক ও আঞ্চলিকতার কারণে অনেক মেধাবী প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় কম নম্বর দিয়ে অকৃতকার্য করা হয়েছে। আর রাজনৈতিক ও আঞ্চলিকতার কারণে তুলনামূলক অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা চাকরির সময় পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।’
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের সময়েও বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের বিভিন্ন পরীক্ষা ও ট্যাকটিসে উত্তীর্ণ না হওয়ার পরও তাদের পাস করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের পেশাদারিত্ব ধ্বংসের জন্য এটাও একটা কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’
নিয়োগজনিত সমস্যার বিষয়ে উল্লেখ করে অন্য এক ডিআইজি বলেন, ‘শূন্য পদ বা সৃষ্ট পদ না থাকা সত্ত্বেও শুধু দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দেওয়ার লক্ষ্যে পুলিশে বহু নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পুলিশে প্রারম্ভিক নিয়োগের ক্ষেত্রে পদ শূন্য হয় অবসরজনিত, মৃত্যুজনিত, অপসারণজনিত বা চাকরি থেকে পদত্যাগজনিত কারণে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিয়োগের ক্ষেত্রে সেই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ মেনে চলা হয়নি।
পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘পিআরবি (পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল), সিআরপিসিসহ (দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর) পুলিশে বিদ্যমান যেসব আইন ও বিধি রয়েছে, সেগুলো পুলিশকে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু বিগত সরকারের সময় এসব আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের সংস্কৃতি চালু করা হয়েছিল। দাঙ্গা বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রচলিত বিধিবিধান অনুসরণ না করে সরাসরি রাবার বুলেট নিক্ষেপ, শটগান ও চাইনিজ রাইফেলের গুলি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্নাইপার দিয়েও গুলি ছোড়া হয়। এই অতিমাত্রায় বল প্রয়োগের সংস্কৃতি ও সরাসরি গুলির নির্দেশ পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব ধ্বংস করে এবং পুলিশের ওপর সাধারণ নাগরিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।’
পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, ‘পতিত সরকারের সময়ে পুলিশের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতিতে ঘুষের কারবার মারাত্মক রূপ ধারণ করে। কনস্টেবল নিয়োগে ঘুষ, কনস্টেবল থেকে এএসআই পদোন্নতিতে ঘুষ, এসআই ও ইন্সপেক্টর পদোন্নতিতে ঘুষ এবং দলীয়করণ করা হয়। ওসি, এসপি, রেঞ্জ ডিআইজি ও মেট্রোপলিটন কমিশনারসহ গুরুত্বপূর্ণ পদায়নে ঘুষের কারবার অনেকটা প্রকাশ্যে চলে আসে, যা পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব ধ্বংস করে দেয়। ঘুষ দিয়ে পদোন্নতি ও পদায়নের কারণে সাধারণ মানুষের ওপর পুলিশকে নিপীড়ন, নির্যাতন ও গ্রেপ্তার বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের সংস্কৃতি চালু হওয়ায় পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।’
পতিত সরকারের সময়ে গায়েবি মামলার পাশাপাশি ফরমায়েশি তদন্তের সংস্কৃতি চালু করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ নিজেরাই হাতবোমা ফাটিয়ে বা অন্য কারও মাধ্যমে বিস্ফোরক ফাটিয়ে কিংবা কোনো ধরনের ঘটনা ছাড়াই গায়েবি মামলা দেওয়ার সংস্কৃতি চালু করে। সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে একটি জর্দার কৌটা বা স্কচটেপ, কিংবা পাথর সংগ্রহ করে সেগুলো মামলার আলামত হিসেবে দেখানো হয়। কোনো এলাকায় মামলা হলে ওই এলাকার বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের কমিটির তালিকা ধরে সবাইকে আসামি করার অপসংস্কৃতি চালু করে কিছু অপেশাদার পুলিশ কর্মকর্তা। এসব মামলায় দলীয় ফরমায়েশ অনুযায়ী তদন্ত করে ফরমায়েশি অভিযোগপত্র দিয়ে লোকজনকে হয়রানি ও অর্থ আদায় করা হয়েছে, যা মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। সংশ্লিষ্টরা উদাহরণ হিসেবে বলেন, বিগত সময়ে ‘রাজনৈতিক মামলা’ নামে একটি বিশেষ টার্ম চালু হয়। যার প্রায় সবই ছিল হয়রানিমূলক। পুলিশ এসব মামলার তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিলেও আদালতে সাজার হার ৭ থেকে ৮ শতাংশে নেমে আসে। পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র আদালতে পুলিশই প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়।
পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, থানাকেন্দ্রিক বাণিজ্য। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তারা বিভিন্ন থানায় ওসি বা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেন। তারা সংশ্লিষ্ট এলাকার সরকারি দলের নেতাকর্মীদের যোগসাজশে বিরোধী মতের নেতাকর্মী বা সাধারণ মানুষকে মামলায় জড়ানো, মামলার হুমকি দিয়ে অর্থ আদায়ের মতো গর্হিত কাজে জড়িয়ে পড়ে। বছরের পর বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকায় পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
জনসাধারণকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে তৈরি হয় কমিউনিটি পুলিশিং ও বিট পুলিশিং সিস্টেম। কমিউনিটি পুলিশের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় স্থানীয় চাঁদাবাজ ও দলীয় ক্যাডারদের। তাদের প্রশ্রয় দেন থানার ওসি, ফাঁড়ির দায়িত্বশীল কিংবা থানার দারোগারা। তারা পুলিশের যোগসাজশে চাঁদাবাজি, অবৈধ দখল, গ্রেপ্তার ও আটক-বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এ বিষয়টিও সাধারণ মানুষকে পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ করে তোলে।
বিগত সরকারের সময়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে। ঢাকাসহ দেশের অনেক থানার ওসির সরাসরি প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা আইজিপির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। কনস্টেবল, এসআই, ইন্সপেক্টর, এসপি ও ডিআইজি পর্যায়ের কর্মকর্তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর লোক হিসেবে নিজেদের জাহির করতেন। ওই কর্মকর্তারা তাদের তদারকি কর্মকর্তা বা দায়িত্বশীলদের পাত্তাই দিতেন না। উল্টো চাকরি খাওয়ার হুমকি পর্যন্ত দিতেন, যা বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ও পেশাদারিত্ব ধ্বংস করে।
পর্যবেক্ষক মহল জানায়, বিগত সময়ে পুলিশ বাহিনী বিশেষ জেলা বা অঞ্চলের লোকের আধিপত্য ও প্রাধান্য ছিল। এ ক্ষেত্রে গোপালগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জকে বেশি প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। গোপালগঞ্জ জেলা থেকে আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার, র্যাবের মহাপরিচালক, এসবি ও ডিবির প্রধান, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি, রেলওয়ে পুলিশের প্রধানসহ অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ও লোভনীয় পদায়নগুলো দেওয়া হয়। এই চক্র পুলিশের পদোন্নতি ও নিয়োগ-বাণিজ্য সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। কিশোরগঞ্জ জেলারও আধিপত্য ছিল পুলিশে। ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলোয় যারা ওসি ছিলেন তারাও বেশিরভাগ গোপালগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা ছিলেন। এতে অন্য জেলার পেশাদার কর্মকর্তারা বঞ্চিত হন। বিশেষ জেলাকে অধিক মাত্রায় প্রাধান্য দেওয়ায় পুলিশের পেশাদারিত্ব ধ্বংস হয়ে পড়ে।
এ ছাড়া বিগত সরকারের সময় পুলিশ বাহিনীতে বড় একটি চক্র তৈরি হয়েছিল। এসব চক্রে ছিলেন সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, এ কে এম শহীদুর রহমান, হাসান মাহমুদ খন্দকার, বেনজীর আহমেদ, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন, এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপি কমিশনার হাবীবুর রহমান, সিআইডি প্রধান ও অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মদ আলী মিয়া, অতিরিক্ত আইজি দেব দাস ভট্টাচার্য, খন্দকার লুৎফুল কবীর, অতিরিক্ত আইজি মীর রেজাউল আলম, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ ও আসাদুজ্জামান, ডিআইজি নূরে আলম মিনা, সৈয়দ নূরুল ইসলাম, মোল্লা নজরুল ইসলাম, অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকার, অতিরিক্ত আইজি ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন, রংপুর রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি আবুদল বাতেন, চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির, পুলিশ সদর দপ্তরের জয়দেব কুমার ভদ্র, ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার ইমাম হোসেন, ডিআইজি শাহ মিজান শফিউর রহমান, ২০ ব্যাচের মো. আনিসুর রহমান, জিহাদুল কবীর, মো. ইলিয়াস শরীফ, শাহ আবিদ হোসেন, মো. জামিল হাসান, ২২তম ব্যাচের খন্দকার নূরুন্নবী, এসএম মেহেদী হাসান, সঞ্জিত কুমার রায়, সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, যশোরের পুলিশ সুপার ও পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রলয় কুমার জোয়ারদারসহ অনেকে। তারা পুলিশের বদলি, পদোন্নতি, পদায়ন নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই চক্রটি ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়নে অনিয়ম, ব্ল্যাকমেইলিং, কেনাকাটায় অনিয়ম ও গ্রেপ্তার বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। পিআরবিসহ প্রচলিত যাবতীয় বিধি লঙ্ঘন করে তারা ‘বিশেষ গোষ্ঠীর’ হয়ে কাজ করেছেন। ফলে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে পেশাদারিত্ব ধ্বংস হয়ে পড়ে।
পুলিশের পেশাদারিত্ব ধ্বংসের পেছনে আরও একটি বিষয় চিহ্নিত করেছেন কর্মকর্তারা। তা হচ্ছে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও গুরুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে শিথিলতা। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ গাজীপুর ও নারায়ণঞ্জের পুলিশ সুপার থাকার সময় নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু তাকে শাস্তির বদলে অতিরিক্ত কমিশনারের (গোয়েন্দা) মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়। এভাবে অনিয়মে জড়ানো কর্মকর্তারা তিরস্কার ও শাস্তির বদলে পুরস্কার পাওয়ায় পুলিশের পেশাদারিত্ব ধ্বংস হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, বিষয়গুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটলে পুলিশ বাহিনী ফের বিপর্যয়ে পড়বে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেন কালবেলাকে বলেন, বিগত বছরগুলোতে শাসকগোষ্ঠী যেভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে, তা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলেছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ পুলিশ, যে প্রতিষ্ঠানের ওপর দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো পবিত্র দায়িত্ব ন্যস্ত, বিভিন্ন সময়ে দেশের জনগণের বিপক্ষে গিয়ে জুলুমকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ করা হয়েছে। কিছু অসাধু রাজনীতিবিদ ক্ষমতা ধরে রাখতে পুলিশকে নাগরিকদের ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। একই সঙ্গে পুলিশের মধ্যে থাকা উচ্চাভিলাষী ও রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট কিছু কর্মকর্তা এবং অধস্তন সদস্যরা সেই রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগসাজশে পুলিশকে অপব্যবহারের পথ সুগম করেছে। তাদের নির্দেশে বিভিন্ন সমাবেশ, মিছিল এবং গণজমায়েতে অযাচিত পুলিশি হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবাধিকারবিরোধী কার্যক্রমের অভিযোগ রয়েছে এবং অনেক অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময়ও তৎকালীন সরকার-সমর্থিত কর্মকর্তারা এবং অনেক অধস্তন সদস্য ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং মানবতাবিরোধী সহিংস বলপ্রয়োগ করে। এর ফলে পুলিশ একটি অকার্যকর ও অবিশ্বাস্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। মোটকথা, বিগত স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার, তাদের পোষ্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, তাদের অনুগত মিডিয়া এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের একটি গোষ্ঠী জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে রাষ্ট্রকে একটি দমনমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিল, সেখানে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান একটি নতুন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যে একটি সুস্থ ও ন্যায়নিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করেছে। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নের লক্ষ্যে যে ধাপগুলো অতিক্রম করা প্রয়োজন, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো পুলিশ বাহিনীর ও তাদের সেবার মানোন্নয়নে কার্যকর সংস্কার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ, নিরপেক্ষ এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে। পুলিশ ও জনগণের সম্পর্কের মধ্যে সৃষ্ট গভীর ফাটল মেরামতের উদ্দেশ্যে বলপ্রয়োগ পদ্ধতি থেকে শুরু করে মানবাধিকার, জনসম্পৃক্ততা, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও জবাবদিহি বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে কমিশন একটি টেকসই সংস্কারের প্রস্তাব করেছে। আশার কথা হচ্ছে, সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর জানান, পুলিশ পুনর্গঠন ও বিভিন্ন ইউনিটের সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের বড় ক্ষেত্র পুলিশ সপ্তাহ। পুলিশের বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো পর্যালোচনার জন্য পুলিশ সপ্তাহের আগেই কিছু প্রস্তুতিমূলক সভা করা হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।