Image description
চালু হয়নি ৩৫ থানা-ফাঁড়ি। ৪৭ ফাঁড়িতে নেই কোনো জলযান। জনবলের চাহিদা ১০ হাজার রয়েছে ১,৯০০।

দেশের নৌপথ নিরাপদ রাখতে গঠিত নৌ পুলিশের কার্যক্রম নানা সংকটে ব্যাহত হচ্ছে। এক যুগেও জনবলসংকট কাটেনি। রয়েছে জলযানের সংকট। বর্তমানে চালু থাকা ১২২টি থানা ও ফাঁড়ির মধ্যে ৪৭টি ফাঁড়িতে কোনো জলযান নেই। যেসব থানা ও ফাঁড়িতে জলযান আছে, সেগুলোর অবস্থাও নাজুক। এমন পরিস্থিতিতে নৌ পুলিশের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ ব্যাপারে শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ির কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা করছেন দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।

নৌ পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নৌপথে চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অবাধে বালু উত্তোলনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত টহল দিতে হয় এই ইউনিটকে। এ ছাড়া চোরাচালান ও অপরাধ দমনে বিভিন্ন সময় বিশেষ অভিযানও পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু এসব অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জলযান ও জনবল নেই ইউনিটটির।

দেশের নৌপথকে অপরাধমুক্ত ও নিরাপদ রাখার প্রয়োজনে শিগগিরই নৌ পুলিশে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগসহ অন্যান্য সংকট কাটানোর কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।

নৌ পুলিশ বলছে, এই ইউনিটে মঞ্জুরীকৃত দুই হাজার ৪০০ জনবলের মধ্যে বর্তমানে রয়েছে এক হাজার ৯০০ জন। ৫০০ জনবল নেই। জনবল ও সরঞ্জামাদির অভাবে চালু করা যাচ্ছে না ২০১৫ সালে অনুমোদনকৃত ৩৫টি থানা ও ফাঁড়ির কার্যক্রম। এসব সমস্যার সমাধান না হওয়ায় ১৭টি জেলা বাদ রেখে বর্তমানে ৪৭টি জেলায় কার্যক্রম চলছে নৌ পুলিশের।

নৌ পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, নৌপথকে অপরাধমুক্ত রাখতে ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় নৌ পুলিশ ইউনিট। দেশের মোট নদীপথের গুরুত্বপূর্ণ সাত হাজার কিলোমিটার পথ বর্তমানে নৌ পুলিশের আওতায় রয়েছে।

এই বিশাল অংশের নিরাপত্তা দিতে অন্তত ১০ হাজার জনবলের প্রয়োজন। ২০২৩ সালে উল্লিখিতসংখ্যক জনবল চেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রস্তাব দেওয়া হয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে দুই হাজার ৫০০ জনবলের প্রস্তাব দিতে বলা হয়। চলতি বছরের প্রথম দিকে দুই হাজার ৫০০ জনবল চেয়ে আবার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু এখনো এর কোনো অগ্রগতি নেই। এ ছাড়া মঞ্জুরীকৃত জনবলের মধ্যে বাকি ৫০০ জনকে যুক্ত করার ফাইলও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে বলে জানা গেছে।

নৌ পুলিশের মাঠ পর্যায়ের দায়িত্বরত একাধিক সদস্য বলছেন,  নৌ পুলিশের একটি স্টেশনের অন্তত একটি করে জলযান থাকলেও কোনো রকমে কাজ চালানো যায়। কিন্তু যেখানে নেই, সেখানে ভাড়া করে কাজ করতে হচ্ছে। এতে দায়িত্ব পালনে ব্যাঘাত ঘটছে। সঠিক সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছা বা অপরাধীদের তাড়া করা যাচ্ছে না। বরিশাল অঞ্চলে একটি ফাঁড়ি থেকে আরেকটি ফাঁড়ির দূরত্ব ৭০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। এতে মাঝপথে কোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলে ঘটনাস্থলে যেতে অনেক দেরি হচ্ছে।

চালু হয়নি ৩৫ থানা-ফাঁড়ি : জনবলসংকটে অনুমোদনের ১০ বছরেও যে ৩৫টি থানা ও ফাঁড়ি চালু হয়নি, এর মধ্যে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নৌ থানা, পটুয়াখালী নৌ থানা, গোপালগঞ্জের বাঁশবাড়িয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ি, রাজবাড়ীর বেলগাছি ফাঁড়ি, কুষ্টিয়ার খোকসা ফাঁড়ি, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর ও বাঘাবাড়ী ফাঁড়ি, জামালপুরের কুলকান্দি ফাঁড়ি, রংপুরের গঙ্গাচড়া ফাঁড়ি, কিশোরগঞ্জের মাইজচর ফাঁড়ি, নেত্রকোনার গাগলাজুর বাজার ফাঁড়ি, ময়মনসিংহের কাচারীঘাট ফাঁড়ি, পিরোজপুরের আমড়াঝুড়ি ফাঁড়ি, সাতক্ষীরার দোবেকী ফাঁড়ি, বাগেরহাটের হিরণ পয়েন্ট, সুপতি, পাঁচগাঁও ফাঁড়ি ও জলেরঘাট ফাঁড়ি, ঝালকাঠি ফাঁড়ি, ভোলার মাঝেরচর ফাঁড়ি, কলাতলীর চর ও ঢালচর ফাঁড়ি, বরগুনার ফাঁড়ি ও জ্ঞানপাড়া ফাঁড়ি, পটুয়াখালীর গলাচিপা ও  বগা ফাঁড়ি, চট্টগ্রামের তৈলারদ্বীপ সঙ্গতীর ও খাটখালী ফাঁড়ি, নোয়াখালীর চেয়ারম্যানঘাট ও সোনাদিয়া ফাঁড়ি, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ফাঁড়ি, রাঙামাটির শুভলং ফাঁড়ি, বান্দরবান ফাঁড়ি, খুলনার আন্ধারমানিক ফাঁড়ি এবং নড়াইলের ইতনা ফাঁড়ি।

শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, অনেক সীমাবদ্ধতার পরও নৌ পুলিশ সদস্যরা তাঁদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। জনবল ঘাটতি, নৌযানের সংকট, পর্যাপ্ত থানা ও ফাঁড়ির সংকট রয়েছে। তাঁরা বলেন, নদীপথে শুধু অপরাধ দমনই নয়, মা ইলিশ সংরক্ষণ এবং জাটকা নিধন প্রতিরোধ অভিযানের নিয়মিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নৌ পুলিশকে ঈদ, বিশ্ব ইজতেমা, প্রতিমা বিসর্জন, নৌকাবাইচ, ওরসের মতো বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নিরাপত্তাও দিতে হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নীতিমালায় সিভিল পদে স্টেনোগ্রাফার, এমএলএসএসসহ ৪০টির মতো পদে জনবল থাকার কথা। কিন্তু অনুমোদন না হওয়ায় নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। 

নৌ পুলিশ প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কুসুম দেওয়ান কালের কণ্ঠকে বলেন, মোট ১৫৭টি থানা ও ফাঁড়ির মধ্যে ১২২টিতে কাজ চলছে। বাকি ৩৫টি জনবল ও সরঞ্জামাদির অভাবে চালু করা যাচ্ছে না। যেগুলো চালু আছে, সেগুলো জনবল ও জলযানের অভাবে ভালোভাবে চালানো যাচ্ছে না। কারণ কোনো থানা বা ফাঁড়িতে অন্তত ৮ থেকে ১২ জনের মতো জনবল প্রয়োজন। বর্তমানে কোনো কোনো ফাঁড়িতে ছয়জনও কাজ চালাচ্ছেন। তবে সংকট সমাধানে আমরা চেষ্টা করছি।

তিনি বলেন, অনুমোদনকৃত ৩৫ থানা ও ফাঁড়ি চালু করা গেলে পর্যায়ক্রমে বাকি ১৭ জেলায়ও নৌ পুলিশের কার্যক্রম চালু করা যেত।