
টেক্সটাইল শিল্পে একসময় বড় অবস্থান ছিল সালমা গ্রুপের। কাঁচা তুলা আমদানি করে সুতা উৎপাদন ও রপ্তানি করে সুনাম কুড়িয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি; কিন্তু করোনা মহামারি, আর্থিক সংকট আর কোম্পানি পরিচালনায় অদক্ষতায় প্রতিষ্ঠানটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। গ্রুপের একজন পরিচালক গত বছর স্বেচ্ছায় খেলাপি হিসেবে ব্যাংকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। আর এই দুর্বল প্রতিষ্ঠানকেই ১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার আয়োজন করেছে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংক পিএলসি। বিনিয়োগ প্রস্তাবে নেই পর্যাপ্ত জামানতও। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সালমা গ্রুপের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ থাকার পরও এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার চেষ্টা করেন ইসলামী ব্যাংকের সদ্য বাধ্যতামূলক ছুটিতে যাওয়া এমডি ও বোর্ড চেয়ারম্যান। এমনকি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা ও একাধিক বিভাগ এই বিনিয়োগে অনীহা প্রকাশ করলেও তিনি বিনিয়োগ ছাড়ে তড়িঘড়ি করেন। কালবেলার অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সালমা গ্রুপের ৫টি কোম্পানির নামে ১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার চেষ্টা করছে ইসলামী ব্যাংক। এর মধ্যে ফান্ডেড ৬০০ কোটি এবং নন-ফান্ডেড ৫২৪ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত এই ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নেই। আবার যে সম্পদ জামানত হিসেবে দেখানো হয়েছে, তার বড় একটি অংশ ব্যাংকে আগে থেকে বন্ধক রাখা। বন্ধকি সম্পত্তি বাদে অবশিষ্ট সম্পদের সর্বোচ্চ মূল্য হতে পারে ১৫ থেকে ১৮ কোটি টাকা। আর নন-ফান্ডেড ঋণের বিপরীতে তারা ৯৪ শতাংশ নগদ জামানত রাখার বিষয়ে অবহিত করেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব জামানতে রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। সালমা গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য স্থানীয় এলসিতে বিক্রি করা ভাউচার জামানত হিসেবে রাখার চেষ্টা করছে। তবে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সব লেনদেন হয়েছে নিজ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই। এ ক্ষেত্রে এই জামানতে বেশিরভাগই ব্যাংকের ফান্ডে জমা হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
তথ্য বলছে, সুরাইয়া স্পিনিং মিল, দবিরুদ্দিন স্পিনিং মিল, তমিজ উদ্দিন টেক্সটাইল মিল, হোমায়রা কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল ও বিএসবি স্পিনিং মিলের বিপরীতে ৪ কোটি ২৯ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৮ ডলার বা ৫২৪ কোটি টাকার এলসি সুবিধা দিচ্ছে ইসলামী ব্যাংকের গুলশান করপোরেট শাখা। একই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপরীতে ফান্ডেড আরও ৬০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ সুবিধা চেয়েছে গ্রুপটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে ‘ভালো প্রতিষ্ঠানের এই পরিমাণ ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জামানত হিসেবে রাখাতে হবে ৭৬৩ কোটি টাকা বা ওই পরিমাণ সম্পদ। অথচ সালমা গ্রুপ যে সম্পদ জামানত হিসেবে দেখাচ্ছে ওই সম্পদের মোট মূল্য ৪০ কোটি টাকারও কম। অর্থাৎ অল্প জামানত রেখে বড় বিনিয়োগ করার চেষ্টা করছে ইসলামী ব্যাংক। শুধু তাই নয়, এ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনাপত্তি নেওয়া হয়নি বিনিয়োগকারী শাখা গুলশান করপোরেটের। এমনকি ইসলামী ব্যাংকের একাধিক বিভাগ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও এ বিনিয়োগে আপত্তি রয়েছে; কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ও সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও শাখা থেকে বিনিয়োগ আপত্তি থাকার পরও অনুমোদনের কাগজপত্র ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে একাধিকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি। আর সদ্য বাধ্যতামূলক ছুটিতে যাওয়া এমডি মুনিরুল মওলাকে ফোন দিলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান। পরে ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নতুন দায়িত্ব নেওয়ায় আমি সালমা গ্রুপের ঋণের বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত নই।’ এ বিষয়ে জানতে তিনি পরে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
একই বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের একাধিক ডিএমডির কাছে জানতে চাইলেও তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ইসলামী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘সালমা গ্রুপের ঋণের বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের প্রধান ব্যক্তিরা আগ্রহী ছিলেন। বিশেষ করে বিদায়ী এমডির আগ্রহের কারণেই ঋণের ফাইল তৈরি করা হয়েছে। এখনো ঋণটি অনুমোদনের জন্য বোর্ডে উঠানো হয়নি। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বোর্ড সভায় ফাইল উঠতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
কোম্পানি পরিচালক যখন ইচ্ছাকৃত খেলাপি: ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সিআইবি রিপোর্ট অনুযায়ী, সালমা গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংকে মেয়াদোত্তীর্ণ দায় ১ হাজার ৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে এসএমএ (স্পেশাল ম্যানশন অ্যাকাউন্ট) দায় ২০৩ কোটি, শ্রেণিবদ্ধ দায় ২২২ কোটি টাকা। আর ২০২৪ সালের অক্টোবর মাস শেষে এই মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ছিল ৫৩১ কোটি টাকা, যার মধ্যে এসএমএ ছিল ২১৭ কোটি টাকা।
অর্থাৎ ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ও এসএমএ ঋণ বাড়ছে। এদিকে, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোহাম্মদ হানিফ শোয়েবের মোট দায়ের মধ্যে ৫৪৯ কোটি টাকা। এই ঋণে এরই মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে ২১৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে এসএমএ দায় ১ কেটি ৭৬ লাখ টাকা। এসব ঋণে গ্যারান্টার হিসেবে রয়েছেন তার স্ত্রী রীতা চৌধুরী। তিনি সালমা গ্রুপের পরিচালক। তার নামে বিভিন্ন ব্যাংকে দায় দাঁড়িয়েছে ৪৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১ কোটি টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ।
শুধু তাই নয়, রীতা চৌধুরী ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ইচ্ছাকৃত বা স্বেচ্ছায় খেলাপি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ওই ঋণ পুনঃতপশিল করে নিয়মিত করেছেন। ইসলামী ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ বলছে, পরিদর্শনকালে বিভিন্ন সময় এই গ্রাহক খেলাপি হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও বর্তমানে ওইসব ঋণ পুনঃতপশিল করা হয়েছে। এ ছাড়া সালমা গ্রুপের মেয়াদোত্তীর্ণ দায়ের পরিমাণও বাড়ছে বলে জানিয়েছে তারা।
জামানত ৮১ শতাংশ জমি: ৯ মার্চ ২০২৫ সালে জামানতের জন্য জমা দেওয়া কাগজপত্রে দেখা যায়, সালমা গ্রুপ ফান্ডেড ৬০০ কোটি টাকার বিপরীতে রাজধানীর পূর্বাচলে ৮১ শতাংশ জমি দেখিয়েছে। সেখানে ৮১ শতাংশ জমির মধ্যে ২০ শতাংশ গ্রহণযোগ্য। এসব জমির মধ্যে ২০৮৯ অজুতাংশ রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করেছে, ২২৯ অজুতাংশ অন্য ব্যাংকের কাছে বন্ধক রয়েছে, আর ১৬৯৪ অজুতাংশ জমির কিছু কাগজপত্র তারা ব্যাংকের কাছে জমা দিয়েছে। এরই মধ্যে মতামতের জন্য ওই কাগজ আইনজীবীদের কাছে পাঠিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে গ্রুপের কাছে ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল কেন এ ধরনের জমি ব্যাংকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গ্রাহক সে বিষয়ে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সালমা গ্রুপের ৯ প্রতিষ্ঠান, চৌধুরী মোহাম্মদ হানিফ সোয়েব ও রীতা চৌধুরীর দেশের বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মোট ৪ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এসব ঋণের মধ্যে ১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ। এ ছাড়া তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গ্যারান্টার হয়েছে। গ্যারান্টার হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণ ৪ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা।
বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পে সালমা গ্রুপ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে আছে। গ্রুপটি মূলত কাঁচা তুলা আমদানি করে এবং সুতা রপ্তানি করে। গুণগত মান, নতুনত্ব এবং টেকসই প্রযুক্তির জন্য প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ছিল; কিন্তু ২০২১ সালের পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি দুর্বল হতে থাকে। এ ছাড়া সালমা গ্রুপ দেশের বিভিন্ন নিটওয়্যার এবং পোশাক কারখানায় সফলতা পেয়েছে।