
জুলাই আন্দোলনে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে করা মামলায় পুলিশের ১ হাজার ৫৯ জন সদস্যকে আসামি করা হয়েছে । এর মধ্যে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র ৫৪ জন । স্বাধীন তদন্ত কমিশন করে বাকি দায়ীদেরও গ্রেপ্তারের চাপ দিয়ে যাচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ ( এনসিপি ) জুলাই আন্দোলনের শরিক দলগুলো । কিন্তু পুলিশ বলছে , অভিযোগের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না মিললে এখনই আর কোনো সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হবে না । বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে গত বছরের জুলাই - আগস্টে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে পুলিশ । সরকারি গেজেট অনুযায়ী , জুলাই অভ্যুত্থানে হামলা ও গুলিতে ৮৩৪ জন শহীদ হয়েছেন , আহত হয়েছেন ১ হাজার ৪০১ জন । আন্দোলন চলাকালে রংপুরে গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহীদ হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ । এ ঘটনায় আবু সাঈদের ভাইয়ের করা মামলায় ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হলেও গ্রেপ্তার হয়েছেন ২ জন । বাকিরা সবাই পলাতক বলে জানিয়েছে পুলিশ । সাঈদ হত্যা মামলার মতো অন্যান্য হত্যা মামলায়ও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ এনসিপির । তাঁরা এ নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরকে নানাভাবে চাপে রেখেছেন বলে জানা গেছে । জুলাই হত্যাকাণ্ডে হওয়া মামলার কার্যক্রম দেখভাল করার জন্য আইজিপি বাহারুল আলমের নেতৃত্বে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে । এতে অতিরিক্ত আইজিপি ছাড়াও বিভিন্ন ইউনিটের প্রধান ও ডিআইজিরাও রয়েছেন ।
মনিটরিং সেলের একটি সূত্র জানিয়েছে , মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের নজরদারিতে রাখলেও এখনই আর কোনো সদস্যকে গ্রেপ্তার করতে রাজি নন । একাধিক মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন , অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন তাঁরা । প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন । তবে তদন্তকারী কর্মকর্তারা তাঁদের এখনই গ্রেপ্তার করতে চাচ্ছেন না । বিভিন্ন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এ বক্তব্য সুপারভাইজার কর্মকর্তারা পুলিশ সদর দপ্তরকে জানিয়েছেন । ঢাকার বিভিন্ন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন , মামলার অভিযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য- প্রমাণ মিললে তারপর অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তার করলেই হবে । এখনই আর গ্রেপ্তারের প্রয়োজন নেই । জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের বিভিন্ন বিভাগ , ইউনিট ও শাখার প্রধানদের দায় রয়েছে । মামলার অভিযোগপত্রে তাঁদের দায় কীভাবে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না মিললে আর গ্রেপ্তার করবে না উল্লেখ করা হবে এবং তাঁদের গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কি না , সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি পুলিশ ।
এসব বিষয়ে তদন্তের শেষ দিকে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানা গেছে । তবে এনসিপি , বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন মামলার উদাহরণ টেনে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তার না হওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন । তাঁরা পুলিশের অপরাধের তদন্ত পুলিশ দিয়েই হোক , এমনটি চাইছেন না । এ জন্য আলাদা কমিশন বা সংস্থা দিয়ে তদন্তের দাবি তুলেছেন তাঁরা । এ বিষয়ে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন , ' জুলাই হত্যাকাণ্ডে যাঁরাই জড়িত থাকুন , তাঁদের শাস্তি হতে হবে । এটি জাতিসংঘের মানবাধিকার রিপোর্ট থেকেও প্রতীয়মান । কাউকেই বিশেষ আনুকূল্য দেওয়ার সুযোগ নেই । আমরা চাই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারপূর্বক বিচার করতে হবে । এতে করে পুলিশের ইমেজই ভালো হবে । জনমনে পুলিশের প্রতি যে ক্ষোভ , তা প্রশমনের একমাত্র উপায় দোষী পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তার ও বিচার করা । '
সরকার বা পুলিশের ওপর চাপ প্রয়োগের কথা অস্বীকার করলেও পুলিশের অপরাধ পুলিশ দিয়ে তদন্ত করা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এনসিপির এই নেতা । তিনি বলেন , পুলিশের অপরাধ অন্য কোনো স্বাধীন কমিশন বা সংস্থা দিয়ে তদন্ত করা উচিত । আমরা সে দাবি সব সময় জানাচ্ছি । যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ , তিনি তদন্ত করলে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট সৃষ্টি হয় । ’ তবে বিভিন্ন রকম জনমত সৃষ্টি করে চাপ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স ( জেআরএ ) মুখপাত্র ফানতাসির মাহমুদ ।
তিনি বলেন , ‘ আমরা বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে এবং ফুটেজ চেক করে গণহত্যাকারী পুলিশদের পরিচয় বের করি এবং আমাদের পেজ থেকে পাবলিশ করি । আমাদের পেজে পাবলিক এনগেজমেন্ট বেশি থাকায় জনমত সৃষ্টি করা যায় । আর এভাবেই প্রেসার ক্রিয়েট করে আমরা গণহত্যার বিচারের কাজে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছি । ' পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে , জুলাই আন্দোলন ঘিরে হওয়া মামলায় পুলিশের ১ হাজার ৫৯ সদস্য আসামি । তাঁদের মধ্যে সাবেক আইজিপি ৫ , সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ৪১ , সাবেক ডিআইজি ( উপমহাপরিদর্শক ) ১২ , বর্তমান ডিআইজি ১২ , সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি ২ , বৰ্তমান অতিরিক্ত ডিআইজি ৪২ , সাবেক এসপি ( পুলিশ সুপার ) ৩ , বৰ্তমান এসপি ৫৯ , অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ৫৬ , সহকারী পুলিশ সুপার ২১ ও পরিদর্শক ১৬৮ জন রয়েছেন । বাকি ৬৩৮ জন এসআই ( উপপরিদর্শক ) , সহকারী উপপরিদর্শক ( এএসআই ) , নায়েক ও কনস্টেবল ।
পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক ( এআইজি ) এনামুল হক সাগর জানিয়েছেন , জুলাইয়ের ঘটনায় সাবেক - বর্তমান ৫৪ পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার রয়েছেন । মামলাগুলো তদন্তাধীন । তদন্তকারী কর্মকর্তারা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন । সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন , পুলিশ তার অস্ত্র ব্যবহার করবে জনস্বার্থে এবং আইনি কাঠামোর ভিত্তিতে । আইন সবার জন্য সমান । ন্যায়ানুগভাবে এসব মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করা উচিত । দোষী - নির্দোষ চিহ্নিত করতে বিলম্ব হলে বাহিনীর সদস্যদের মনোবলে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে । তবে তদন্ত কর্মকর্তার কাজে কেউ যাতে হস্তক্ষেপ না করেন , সে বিষয়ে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন ।