
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের সদস্য মো. ইব্রাহীম সরকার। গত ১৯ ডিসেম্বর অনলাইনে রেলের টিকিট কাটতে গিয়ে দেখতে পান, আগেই তার আইডি ব্যবহার করে কেউ একজন টিকিট কেটে নিয়েছে। এ ঘটনায় তিনি খিলগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
ইব্রাহীম সরকার কালবেলাকে বলেন, আমি অনলাইনে রেলের টিকিট কাটতে গেলে দেখতে পাই আমার আইডি ব্যবহার করে আগেই কেউ একজন কিশোরগঞ্জের টিকিট কেটে নিয়েছে। অথচ আমার কিশোরগঞ্জে কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। এভাবে যারা আমার অজান্তে অনলাইনে রেলের টিকিট নিতে পারে, তারা মোবাইল ও এনআইডি নম্বর ব্যবহার করে আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টও তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়াসহ যে কোনো অপরাধ সংঘটিত করতে পারে। এসব ভেবেই আমি থানায় জিডি করেছি।
রাজশাহী প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. শামসুজ্জোহা জানান, তার ঘনিষ্ঠ রাজশাহীর সিনিয়র সাংবাদিক আনিসুজ্জামানের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে রেলওয়ে থেকে সম্প্রতি ৮৮৩৮৩৪ নম্বরধারী একটি ওটিপি কোড আসে। অথচ তিনি রেলওয়ের অ্যাপসে প্রবেশই করেননি। পরবর্তী সময়ে তিনি রাজশাহী রেলস্টেশনে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন তার আইডি ব্যবহার করে অন্য কেউ টিকিট কেটেছে।
আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত খিলক্ষেত এলাকার বাসিন্দা মো. পলাশ খান বলেন, তিনি রেলওয়ের অ্যাপসে প্রবেশ না করলেও তার মোবাইলে একটি ওটিপি কোড আসে। তিনি এ ব্যাপারে তেমন কোনো খোঁজখবর নেননি। তবে বিস্মিত হয়েছেন। কারণ, তিনি রেলওয়ের অ্যাপসে প্রবেশ করেননি কিংবা টিকিটের জন্যও চেষ্টা করেননি। তাহলে কীভাবে তার মোবাইল নম্বরে ওটিপি কোড এলো। এ নিয়ে তিনি ব্যক্তিগত তথ্য হারানোর ঝুঁকি দেখছেন।
গত দুই দশকে বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকিট বিক্রির পদ্ধতি ও অপারেটর বদলেছে কয়েকবার। তবুও থামানো যায়নি সিন্ডিকেট গড়ে ‘টিকিট কালোবাজারি’ এই ভয়াবহ অপকর্ম। রেলওয়ের ‘রেলসেবা’ অ্যাপসের জন্য যাত্রীদের ফোন নম্বর ও এনআইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা আইডি ব্যবহার করে নিজেদের ইচ্ছামতো অনলাইনেও টিকিট হাতিয়ে নিয়েছে কালোবাজারি চক্র। শুক্রবার সকালে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে তেমনই এক চক্রের সদস্যকে আটক করেছে রেলওয়ে পুলিশ। রাকিব মিয়া নামে ওই যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নিজের ও পরিচিতদের এনআইডি ব্যবহার করে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করতেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, রেলের টিকিট কালোবাজারিদের টিকিট বাজারজাতকরণে বা এসব টিকিটের যাত্রী জোগাড় করতে কাজ করে এক শ্রেণির আবাসিক হোটেল বয়, ক্লিনার, পাঠাও চালক এবং স্টেশনে অবস্থিত ছোট ছোট দোকান কর্মচারী। এ চক্র কালোবাজারিদের মাধ্যমে সংগৃহীত টিকিট নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ বা তারও বেশি দামে বিক্রি করছে। এমনকি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে এ চক্রের নির্ধারিত যাত্রীর (যারা অবৈধ উপায়ে টিকিটপ্রত্যাশী) হোয়াটসঅ্যাপে চাহিদা মোতাবেক টিকিট পাঠিয়ে দেয়।
টিকিট কালোবাজারিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যসহ রেলস্টেশনে কর্মরত অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রেল মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তাসহ সার্ভার রুম ও আইটি সদস্যদের সহযোগিতায় হচ্ছে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি। অ্যাপসে করা যাত্রীদের আইডি ব্যবহার করে বুকিং সহকারীরা নিজেদের ইচ্ছামতো অনলাইনে টিকিট হাতিয়ে নিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধান বুকিং ক্লার্ক ও কিছু বুকিং সহকারীর (কাউন্টারম্যান) নেতৃত্বে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ‘টিকিট কালোবাজারি’ শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে ২, ৩, ৪ এবং ৫ নম্বর কাউন্টার থেকে হচ্ছে টিকিট জালিয়াতি।
টিকিট জালিয়াতির বিষয়টি স্বীকারও করেছেন এক বুকিং সহকারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালবেলাকে তিনি বলেন, কমলাপুর রেলস্টেশনে বুকিং কাউন্টার আছে ২০টি। এর মধ্যে ২ থেকে ৫ নম্বর কাউন্টার থেকেই অধিকাংশ টিকিট জালিয়াতি হচ্ছে।
টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত অভিযোগে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিমানবন্দর রেলস্টেশনের বুকিং সহকারী সাথী আক্তারকে, ৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনের বুকিং সহকারী মো. নূর আলম মিয়া এবং ৪ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের বুকিং সহকারী ও টিকিট কালোবাজারির অন্যতম হোতা মো. রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তাদের গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করে ঢাকা রেলওয়ের এসপি আনোয়ার হোসেন বলেন, এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তবে রেলওয়েকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।
তিনি বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে পেশাদার এক টিকিট কালোবাজারিকে আটক করেছে পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ রুটের ভিন্ন ভিন্ন তারিখের ২১টি আসনের টিকিট ও একটি স্মার্ট মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। এসব টিকিট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অধিক দামে বিক্রির কথা স্বীকার করেছেন আটক যুবক।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার আনোয়ার হোসেন বলেন, রেলের যাত্রীরা যার টিকিট তিনি নিজেই কাটেন, অন্য কেউ কাটতে পারে না। একজনের আইডি ব্যবহার করে অন্য কেউ রেলের টিকিট কাটার কোনো সুযোগ নেই।
এ ব্যাপারে অ্যাপস প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অরেঞ্জ বিডির প্রধান তথ্য কর্মকর্তা মো. শামীম হোসেন বলেন, কোনো যাত্রীর রেজিস্ট্রেশন করা আইডি থেকে অন্য কেউ রেলের টিকিট কাটলে তা শুধু দুইভাবে সম্ভব। প্রথমত ম্যানেজমেন্টের কেউ সার্ভার থেকে অ্যাক্সেস নিয়ে এ অপকর্ম করতে বা করাতে পারেন। আর দ্বিতীয়ত সিস্টেম লেভেলে সিকিউরিটির দুর্বলতা। অর্থাৎ অনলাইন টিকিট ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্তদের যোগসাজশ ছাড়া এমনটি কোনোভাবেই করা সম্ভব নয়।
তথ্য বলছে, আসন্ন ঈদুল ফিতরকে টার্গেট করে দেশের বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে বুকিং সহকারীদের মাধ্যমে রেলের টিকিট কালোবাজারির একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। অনলাইন ও কাউন্টার থেকে বিভিন্ন কৌশলে এই চক্রের সদস্যরা টিকিট সংগ্রহ করে। কখনো চক্রের সদস্যরা নিজেরা আবার কখনো তাদের স্বজন, হকার, কুলি, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ভিক্ষুকসহ বিভিন্ন ধরনের লোকদের দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করায়। আর টিকিটপ্রতি এদের দেওয়া হয় একশ টাকা।
ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আরিফ বলেন, যাত্রীদের রেজিস্ট্রেশন করা আইডি ব্যবহার করে তার অজান্তে অন্য কেউ টিকিট কাটতে পারে, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এ ঘটনা ঘটে থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে দোষী ব্যক্তিকে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, এটা হয়ে থাকলে গুরুতর অপরাধ। বিষয়টি আমরা দেখব। তাতে যেই জড়িত থাকুক, সেটা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হলেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।