
পুলিশ প্রশাসনে অস্বস্তি কাটছে না। হাইকমান্ডে অস্থির অবস্থা বিরাজ করায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় ফিরছে না শৃঙ্খলা। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে স্বাভাবিক কার্যক্রম। এ কারণে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না পুলিশ। আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে এনালগ মডেল আরোপ, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, গুরুত্বপূর্ণ পদে ফ্যাসিবাদের দোসদের পদায়নসহ নানা কারণে পুলিশ প্রশাসনে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম যুগান্তরকে বলেন, পুলিশের ভেতর এখন কোনো অস্বস্তি নেই। শৃঙ্খলা পুরোপুরি ফিরে এসেছে। তিনি বলেন, পদ খালি থাকলেই পদোন্নতি দিতে হবে-এটা কোনো আইনে বলা নেই। তিনি আরও বলেন, পুলিশের কারও মধ্যে কোনো ক্ষোভ নেই। সবাই স্বচ্ছন্দে সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করছে।
সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশের নেতৃত্বে পরিবর্তন শুরু হয় গত বছরের ৭ আগস্ট। অবকাঠামোগত সমস্যা ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে নতুন নেতৃত্ব। গণ-অভ্যুত্থানের জেরে বন্ধ হয়ে যাওয়া থানাগুলোকে সচল করেন তারা। ষড়যন্ত্রমূলক বিভিন্ন অন্দোলন সামাল দিয়ে উন্নতি ঘটাতে থাকেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। ওই সময় বিশেষ জায়গা থেকে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে পরামর্শ আসে, আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে কনভেনশনাল পুলিশিং বা এনালগ পুলিশিং মডেল আরোপ করতে হবে। কিন্তু পুলিশের নতুন নেতৃত্ব ডিজিটাল বা টেকনোলজি-বেইজড পুলিশিংয়ের ওপর জোর দেয়। এতে উষ্মা প্রকাশ করে বিশেষ মহল। ফলে পরিবর্তন আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে।
শুধু তাই নয়, বিশেষ মহলের পক্ষ থেকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ ধারণা দেওয়া হয় যে, বিএনপিপন্থি অফিসাররাই পুলিশ সদর দপ্তর, মেট্রোপলিটন পুলিশ, রেঞ্জ এবং জেলায় পদায়ন হয়ে পুলিশ বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে হলে পুলিশ বাহিনীকে নিউট্রালাইজ করতে হবে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বিএনপিপন্থি বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে। একাধিক জায়গায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় অবসরপ্রাপ্তদের। পাশাপাশি কিছু কিছু জায়গায় আনা হয় পরিবর্তন। এদিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তরা দীর্ঘদিন পুলিশিংয়ের বাইরে থাকায় বাহিনীর ভেতর সমন্বয় সাধনে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছেন। এছাড়া নতুন করে পদায়নপ্রাপ্তরা পারছেন না দক্ষতা দেখাতে। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি থামছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশের গ্রেড ওয়ান পদ দুটি। একটিতে চুক্তিভিত্তি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্য পদটি শূন্য আছে। যাদের গ্রেড ওয়ান পদ পাওয়ার কথা তারা পদোন্নতি পাচ্ছেন না। এতে অনেকেই বঞ্চিত মনে করছেন। তারা জানান, বর্তমানে পুলিশে অতিরিক্ত আইজিপি পদের সংখ্যা ২৭টি। এগুলোর মধ্যে সৃজনকৃত পদ ২০টি এবং সুপারনিউমারারি (পদ না থাকলেও পদোন্নতি) সাতটি। সব মিলিয়ে অতিরিক্তি আইজিপির ১৯টি পদই এ মুহূর্তে শূন্য আছে। দীর্ঘদিন ধরে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভা না হওয়ায় এসব পদ পূরণ করা যাচ্ছে না। পুলিশের ইতিহাসে কখনো উচ্চ পর্যায়ে এতগুলো পদ খালি থাকেনি। বিষয়টি নিয়ে পদোন্নতিপ্রত্যাশীরা আইজিপির রুমে গিয়ে প্রতিবাদও জানিয়েছেন। কেবল তাই নয়, নিজেদের পদোন্নতি বঞ্চিত মনে করে বিভিন্ন ব্যাচের কিছু কর্মকর্তা সম্প্রতি অফিসার্স ক্লাবে একটি মিটিং করেছেন। ইফতার মাহফিলের ব্যানারে করা ওই মিটিংয়ে ঢাকার বাইরে থেকে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা যোগ দিয়েছিলেন তাদের কারণ দর্শানো নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় অনেক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাদের মতে, অতিরিক্ত আইজি পদে পদোন্নতি না হওয়ায় অন্যান্য পদেও পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে। কারণ, এই পদে পদোন্নতি হলে অন্যান্য পদে পদোন্নতির পথ সুগম হতো। সহজেই অতিরিক্ত ডিআইজিরা ডিআইজি হতে পারতেন, এসপিরা হতে পারতেন অতিরিক্তি ডিআইজি, এসপি পদে পদোন্নতি পেতেন অতিরিক্ত এসপিরা।
পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানায়, পুলিশ প্রশাসনকে নিউট্রালাইজ করার নামে আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী ‘বি টিম’-এর সদস্যদের (যারা আওয়ামী লীগ আমলে জেলার এসপি. মেট্রোপলিটন কমিশনার বা রেঞ্জ ডিআইজি ছিলেন না, কিন্তু বিভিন্ন ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন) গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে পদায়ন করা হচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে ওই সূত্র জানায়, আওয়ামীপন্থি পুলিশ সুপার নাজির আহম্মেদ খান ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সহকারী কমিশনার (এসি) থেকে উপ-কমিশনার (ডিসি) পর্যন্ত ডিএমপির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে কর্মরত ছিলেন। অথচ তাকে কুমিল্লা জেলার এসপি হিসাবে পদায়ন করা হয়েছে।
ওই সূত্র জানায়, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের অন্যতম সুবিধাভোগী সাইফউদ্দীন শাহীন। গত কয়েক বছর ধরে তিনি ছিলেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) ডিসি (হেডকোয়ার্টার)। এসপি এবং অতিরিক্ত এসপি থাকা অবস্থায় তিনি কক্সবাজারে কর্মরত ছিলেন। সম্প্রতি তাকে কক্সবাজারের এসপি হিসাবে পদায়ন দেওয়া হয়। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে গত আওয়ামী লীগ সরকার আমলেও তার পদোন্নতিতে সমস্যা হয়েছিল। তিনি যুগান্তরকে বলেন, চাকরি জীবনে আমি কখনো শোকজও খাইনি। আমার প্রমোশন অওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই হয়েছে।
নৌ-পুলিশের বর্তমান ডিআইজি মিজানুর রহমানের শ্বশুর আব্দুল করিম ছিলেন মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় তিনি (মিজান) গোপালগঞ্জের এসপি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসপি। মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করলেও আমি স্বৈরাচারের সহযোগী নই। কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হইনি। আমার শ্বশুর যখন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন তখন দেশের বেশির ভাগ মানুষই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে আরএমপি কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করা আবু কালাম সিদ্দিককে ডিআইজি হিসাবে পদায়ন করা হয়েছে শিল্প পুলিশে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার থেকে অতিরিক্ত কমিশনার পর্যন্ত কর্মরত অবস্থায় বেশির ভাগ সময় মহা. আশরাফুজ্জামান ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি)। সম্প্রতি তাকে রংপুর পুলিশ সেন্টারে (পিটিসি) কমান্ড্যান্ট (ডিআইজি পদমর্যদা) হিসাবে পদায়ন করা হয়েছে। আব্দুর রউফ খানকে রেলওয়ের ডিআইজি হিসাবে পদায়ন করা হয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় তিনি ছিলেন খুলনার পুলিশ সুপার। মোহাম্মদ হায়াতুন নবীকে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসাবে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এডিশন অ্যান্ড ফিন্যান্স উইংয়ে পদায়ন করা হয়েছে। অথচ ফ্যাসিবাদ আমলে তিনি এসপি থেকে এডিশনাল আইজি পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ে এসবিতেই ছিলেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএনপিপন্থি পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্বে) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম এসবিতে ছিলেন। তাকে সরিয়ে সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গোলাম রসুলকে। দীর্ঘদিন পুলিশ স্টাফ কলেজে কর্মরত থাকা অবস্থায় মুজিব কর্ণার স্থাপন ও মুজিবের ওপর গবেষণা প্রবন্ধ লিখে সমালোচিত হয়েছিলেন গোলাম রসুল। ডিএমপিতে অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যাপস) ইসরাইল হাওলাদারকে বদলি করে তার স্থলে এসএন নজরুল ইসলামকে পদায়ন করা হয়। এছাড়া তেজগাঁও, ওয়ারী এবং গুলশান বিভাগের ডিসিকে সরিয়ে নতুন অফিসারদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা কেউ আগের অফিসারদের মতো দক্ষতা দেখতে পারছেন না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তারা জানান, এহসানুল হক সমাজী নামের এক আইনজীবীকে অ্যাটর্নি জেনারেলের মর্যদায় পুলিশ সদর দপ্তরে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাকে একটি অফিস কক্ষ ও গাড়ি দেওয়া হয়েছে। বিষয়টিকে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ভালো চোখে দেখছেন না।