
‘আমার মা-বাবাসহ ছয় স্বজনকে ওমরাহ হজে পাঠানোর জন্য গত জানুয়ারি মাসে বার্ডস আই হেলিকপ্টার অ্যান্ড হজ কাফেলা সার্ভিসেসে যোগাযোগ করি। এই এজেন্সির মালিক রাজীব মাহমুদের কথা শুনে মনে হয়েছিল, এখানে কোনো ঝুঁকি নেই। তাছাড়া তাঁর অফিসের অবস্থান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের ভেতরে। এ কারণে তাঁকে সন্দেহ করতে পারিনি। কিন্তু ফ্লাইটের ডেট দিয়ে একবার ঘোরানোর পর সন্দেহ হয়। পরের বার আরেক দফা ডেট দেন রাজীব। এর কয়েক দিন আগে থেকে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সব গুটিয়ে তিনি পালিয়েছেন। তখন নিশ্চিত হই, রাজীব একজন বাটপার। হজের মতো বিষয় নিয়ে মানুষ প্রতারণা করতে পারে– ভাবিনি।’
আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ইমতিয়াজ আহমেদ ইমন। তাঁর বাসা রাজধানীর বাড্ডা এলাকায়। হজ পালনের জন্য মা-বাবা, ছোট বোন ও খালাতো ভাইয়ের পরিবারের তিনজনকে ওমরাহ পালনে সৌদি আরব পাঠাতে নিজের হাতে এজেন্সি মালিক রাজীবকে মোট ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়েছেন রাজীব।
শুধু ইমতিয়াজের ছয় স্বজন নন, এভাবে দুই শতাধিক ওমরাহ হজযাত্রী বার্ডস আই হেলিকপ্টার অ্যান্ড হজ কাফেলা সার্ভিসেসে মোট প্রায় ৫ কোটি দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় এজেন্সি মালিক রাজীব, তাঁর স্ত্রী নীলা আক্তারসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ১ মার্চ মামলাটি করেন আশরাফুল আলম নামে এক ভুক্তভোগী। মামলার পর থেকে রাজীবের অফিস তালাবদ্ধ। মামলার অন্য আসামিরা হলেন– নিশাত, আল মাহমুদ হাবিব, মিনহাজুল ইসলাম, ইফতেখাইরুল আলম, সুপ্তি, মিনহাজ, সুরভি, স্মৃতি, মিথিলা, ফাতেমা, মনীষা, জেরিন, রোহান ও রবিন।
রাজীবসহ প্রতারণায় জড়িতদের বিচার দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার বার্ডস আই হেলিকপ্টার অ্যান্ড হজ কাফেলা সার্ভিসেসের অফিসের সামনে ‘অবস্থান ধর্মঘট’ করেন ভুক্তভোগীরা। তাদের অভিযোগ, এই প্রতারণার সঙ্গে বিমানবন্দরের কিছু লোকও জড়িত।
ইমতিয়াজ আহমেদ সমকালকে জানান, তাঁর বাবা নাজিমুদ্দিন, মা নাসরিন সুলতানা, ছোট বোন ইসরাত সুলতানা মিলা এবং তাঁর খালাতো ভাইয়ের পরিবারের তিনজন চলতি রমজান মাসে ওমরাহ হজে যেতে চেয়েছিলেন। সেজন্য অনলাইনে খোঁজ নিয়ে বার্ডস আই হেলিকপ্টার অ্যান্ড হজ কাফেলা সার্ভিসেসে যোগাযোগ করেন ইমতিয়াজ।
গ্রুপ টিকিটে খরচ কম পড়বে বলে অগ্রিম টিকিট কাটার প্রলোভন দেখান এজেন্সি মালিক রাজীব। তাঁর কথামতো ১৪ জানুয়ারি জনপ্রতি ৯০ হাজার টাকা করে মোট ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেন ইমতিয়াজ। প্রথমে ২৫ ফেব্রুয়ারি ফ্লাইটের তারিখ দেওয়া হয়। কিন্তু দুই দিন আগে রাজীব সমস্যার কথা বলে ৪ মার্চ, অর্থাৎ গতকাল ফ্লাইটের দিন দিয়েছিলেন। তিনি টিকিট কাটার নথিপত্রও ইমতিয়াজকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে এজেন্সিতে খোঁজ নিয়ে ইমতিয়াজ জানতে পারেন, রাজীব টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়েছেন। এ ছাড়া টিকিট কাটার যে নথি পাঠিয়েছিলেন, সেটিও ভুয়া। আসলে রাজীব কোনো টিকিটই কাটেননি।
রাজীব মাহমুদের বাড়ি রাজশাহীর রাজপাড়ার হরগ্রামে। তবে বর্তমানে তিনি পরিবার নিয়ে গাজীপুরের জয়দেবপুরের চত্বর শিমুলতলী এলাকায়। তিনি এখন কোথায় গেছেন, তা কেউ বলতে পারছেন না।
গতকাল ‘অবস্থান ধর্মঘট’ কর্মসূচিতে আসেন ডেমরা এলাকার বোরহান উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী তাহমিনা বেগম। তারাও হজে যাওয়ার জন্য রাজীবকে টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এই দম্পতি বলেন, ‘আমরা দুজন হজে যেতে রাজিবের অফিসে বসে দুই ধাপে মোট ২ লাখ ৯১ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু হজে যেতে পারিনি। বিমানবন্দরের মতো জায়গায় এমন প্রতারক কীভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসে, তা বুঝতে পারছি না। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, মামলার পরদিন তিন নম্বর আসামি নীলা আক্তারসহ পরিবারের লোকজন বিমানবন্দর থানার ওসি তাসলিমা আক্তারের সঙ্গে দেখা করেছেন। বাদী আশরাফুলসহ ভুক্তভোগী অন্য যাত্রীরা বলেন, নীলা আসামি হয়েও বিমানবন্দর থানা পুলিশের সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি। বিষয়টি রহস্যজনক।
নীলার থানায় আসার বিষয়টি স্বীকার করে ওসি তাসলিমা বলেন, মামলা হলেই যাচাই-বাছাই ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করতে হবে– এমন কোনো নিয়ম নেই। নীলা আসামি হলেও তাঁর স্বামী রাজীবকে গ্রেপ্তারে তাঁকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার রওনক জাহান একই কথা জানান। তিনি বলেন, মামলা হলেই আসামিকে গ্রেপ্তার করতে হবে, এমন বিধান নেই। আসামির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার এসআই জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রাজীবকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত। তিনি যাতে বিদেশে পালাতে না পারেন, সে ব্যাপারে ইমিগ্রেশনকে অবহিত করা হয়েছে।