
ঢাকার ‘মিলনবিন্দু’ শাহবাগ। সংকট, সংগ্রাম, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, অভ্যুথানসহ সব ইতিহাসের মিছিল ও স্লোগান গিয়ে ঠেকেছে যে জনসমুদ্রে, সেটির নাম শাহবাগ। এ যেন বাংলাদেশের মানুষের ‘দ্রোহের মঞ্জিল’!
এই যে শাহবাগের রাজনৈতিক ফিরিস্তি, তা কি এক দিনে গড়ে উঠেছে? না, সময় লেগেছে! এর অবয়ব বা ‘স্ট্রাকচারাল ফুলস্কেচ’ কীভাবে গড়ে উঠেছিল, তা জেনে নেওয়া যাক মোগল আমল থেকে বাংলাদেশ আমলের ইতিহাসের মহাফেজখানা ঘেঁটে।
শাহবাগের গোড়াপত্তন
মোগল শাসনামলে, অর্থাৎ সতেরো শতকের দিকে শাহবাগের গোড়াপত্তন হয়। মানুষ বসবাস শুরু করে, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে এবং হাটবাজার গড়ে ওঠে।
ওই সময় পুরান ঢাকা ছিল সুবা বাংলার রাজধানী। তখন শাহবাগ অঞ্চলের নাম ছিল ‘বাগ-ই-বাদশাহি’। এটি মূলত ফারসি নাম। মোগল আমলে ফারসি ছিল রাজদরবারের ভাষা। অর্থাৎ রাজার দরবার থেকে শুরু করে রাজকার্য এবং অন্য সব কাজেই ফারসি ভাষা ব্যবহার করা হতো। কালের বিবর্তনে লোকমুখে ‘বাগ-ই-বাদশাহি’ ছোট হতে হতে ‘শাহবাগ’ হয়ে যায়। ফারসি ভাষায় ‘বাগ’ অর্থ বাগান আর ‘শাহ’ অর্থ রাজা। অতএব শাহবাগ অর্থ দাঁড়ায় ‘রাজাদের বাগান’। ওই সময় শাহবাগ অঞ্চলটিতেই ছিল মোগল বাদশাহদের বিশাল বাগানবাড়ি।

ঢাকার ইতিহাস–সম্পর্কিত বইপত্র আর দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে জানা যায়, শাহবাগে বর্তমান ফুলের দোকানের পেছনের অংশের দিকে ছিল ‘জিমখানা ক্লাব’। ১৮২৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়োগকৃত ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস এ ক্লাবের সামনেই রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় প্রবর্তন করেন। ঢাকার নবাব আবদুল গনির সময়ে উনিশ শতকের ষাটের দশকে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়। ইংরেজ ও ঢাকার নবাবদের মনোরঞ্জনকারী এই ঘোড়দৌড় বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশক পর্যন্ত চালু ছিল।
দ্রোহ-বিদ্রোহ, প্রতিরোধ-প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে শাহবাগ এখনো জীবন্ত। শাহবাগ এখন থিসিস-এন্টিথিসিসের এক ‘এজমাইলি ময়দান’।
শাহবাগের অবস্থান
শাহবাগ এলাকাটি পুরান ও আধুনিক ঢাকার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকা তার রূপ, রং, গন্ধ আর সৌন্দর্য ধীরে ধীরে হারাতে থাকে। একপর্যায়ে চরম অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে শাহবাগে বাদশাহদের প্রাসাদ, বাগান ও আশপাশের এলাকা।
শাহবাগের উত্থান
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় ইংরেজদের শাসন শুরুর পর ঢাকা বিকশিত হতে থাকে।
তখন ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট জাজ ফ্রানসিস গ্রিফিথের সহযোগিতায় শাহবাগের বাগানগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করে সুন্দর করে সাজানো হয়। সৌন্দর্যবর্ধনের ওই কাজে মিস্টার গ্রিফিথকে আর্থিকসহ নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন ঢাকার আর্মেনীয় জমিদার মিস্টার আরাতুন।
১৮৪০ সালের দিকে রমনা উদ্যানের উত্তর দিকে অনেক ইংরেজ ও সম্ভ্রান্ত বাঙালি, অবাঙালি বাড়ি বানান। এগুলো মূলত ছিল বাগানবাড়ি। এর মধ্যে একজন ছিলেন আর্মেনীয় জমিদার আরাতুন। তাঁর বাড়ি ছিল বর্তমান টিএসসি ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের কাছে।
অবশ্য খানিক দূরে ‘সুজাতপুর এস্টেট’-এর মধ্যে বাড়ি বানিয়েছিলেন ইংরেজ বিচারক ফ্রান্সিস গ্রিফিথ। তিনি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৮৪৫ সালের দিকে নিজের সব সম্পত্তি ঢাকার শৌখিন নবাব আবদুল গনির কাছে বিক্রি করে দেন। আবদুল গনির বাবা খাজা আলিমুল্লাহ ছিলেন প্রভাবশালী সুন্নি জমিদার। তাঁর পূর্বপুরুষ আবদুল হাকিম কাশ্মীর থেকে পূর্ববঙ্গে এসে ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
খাজা আহসানউল্লাহ তাঁর প্রধান প্রসাদের নাম দিয়েছিলেন ‘ইশরাত মঞ্জিল’। সেখানে একটি চিড়িয়াখানাও বানিয়েছিলেন তিনি। পুরো এলাকা মোগলদের বাগ-ই-বাদশাহির অনুকরণে রেখেছিলেন ‘শাহবাগ’।
ইতিহাসে ‘ইশরাত মঞ্জিল’
১৮৬৮ সালে নবাব আবদুল গনি জমিদারির দায়িত্ব দেন তাঁর পুত্র খাজা আহসানউল্লাহকে। আহসানউল্লাহ অবসর সময় কাটাতে বাগানবাড়ি বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। ইংরেজ বিচারকের গ্রিফিথের কাছ থেকে কেনা সম্পত্তিতে ১৮৭৩ সালে ওই বাগানবাড়ির কাজ শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ জাতীয় জাদুঘর, পাবলিক লাইব্রেরি এলাকায় নবাবদের বাগানবাড়ি ছিল। এর আয়তন ছিল প্রায় ২০০ বিঘা। পুরোনো রেকর্ডে ওই এলাকার নাম ছিল ‘মহল্লা সুজাতপুর’। বাগানের মধ্যে কয়েকটি প্রাসাদও ছিল। নানা ধরনের গাছপালার পাশাপাশি বেশি-বিদেশি ফুল ও ফলের বাগান ছিল। খাজা আহসানউল্লাহ তাঁর প্রধান প্রসাদের নাম দিয়েছিলেন ‘ইশরাত মঞ্জিল’। সেখানে একটি চিড়িয়াখানাও বানিয়েছিলেন তিনি। পুরো এলাকা মোগলদের বাগ-ই-বাদশাহির অনুকরণে রেখেছিলেন ‘শাহবাগ’। খাজা আহসানউল্লাহর ছেলে স্যার খাজা সলিমুল্লাহ। তিনি শাহবাগের উত্তর পাশে তাঁর বোন ‘পরীবানু’র নামে ১৯০২ সালে তৈরি করেন ‘পরীবাগ’।
‘হোটেল শাহবাগ’–এর পথচলা
কালের পরিক্রমায় খাজা পরিবারের কাছ থেকে ইশরাত মঞ্জিল কিনে নিয়ে ১৯৫১ সালের দিকে হোটেল শাহবাগে রূপান্তর করা হয়। এর নকশা করেছিলেন দুই ব্রিটিশ স্থপতি এডওয়ার্ড হিকস ও রোনাল্ড ম্যাককোনেল। বলা হয়, শাহবাগ হোটেল ছিল ঢাকার প্রথম ‘থ্রি স্টার’ হোটেল। এর আয়তন ছিল ১ লাখ ২৩ হাজার ১২৪ বর্গফুট। বিল্ডিং ছিল চারতলাবিশিষ্ট। নিচতলায় লাইব্রেরি, লাউঞ্জ, বিলিয়ার্ড রুম, ব্যাংকুয়েট, হল ও ভোজনাগার।
শাহবাগ হোটেল তৈরির উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) সদস্য, বিশিষ্ট ব্যক্তি, পূর্ব পাকিস্তানের অভিজাত ব্যক্তিদের ব্যবসা ও রাজনৈতিক কাজে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা। ওই হোটেল তিনটি আমল পেয়েছে—ব্রিটিশ, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশ।
হোটেল শাহবাগ নিয়ে প্রথম আলোর কাছে স্মৃতিচারণা করেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক, শিক্ষক ও গবেষক আফসান চৌধুরী। তিনি জানান, ষাটের দশকে তাঁর পরিবার থাকত মগবাজারের দিলু রোডে। তাঁর বড় ভাই মাসুদ চৌধুরী ওই সময়ে চাকরি করতেন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় পাট রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘র্যালি ব্রাদার্সে’। এটি ছিল ব্রিটিশদের কোম্পানি। আফসান চৌধুরীর বাবা ছিলেন পাকিস্তান ন্যাশনাল ব্যাংকের ডিএমডি। ১৯৬৮ সালে তাঁর বড় ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হয় হোটেল শাহবাগে। সেখানে তখন ঢাকার অভিজাত পরিবারের সদস্যদের বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান হতো।
আফসান চৌধুরী জানান, শাহবাগ হোটেলের মালিক ছিলেন অবাঙালি। ওই হোটেলের সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা হতো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও পূর্বাণীর সঙ্গে।
হোটেল থেকে হাসপাতাল
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী জহুর আহমেদ চৌধুরীর উদ্যোগে শাহবাগ হোটেলকে ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের কার্যালয়ে পরিণত করা হয়, যেটিকে সংক্ষেপে সবাই পিজি হাসপাতাল বলত। পরে ১৯৯৮ সালে পিজি হাসপাতাল পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। বর্তমানে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর নতুন নাম ‘বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’।

শাহবাগের ওই বাগানবাড়িগুলো ছিল নবাবদের পারিবারিক বিলাসী জীবনযাপনের লীলাভূমি। সেখানে ঢাকার ‘এলিট’ জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি ইংরেজ সরকারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আগমন উপলক্ষে মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো। সেখানে জাঁকজমকভাবে সাহেব ও মেমদের আপ্যায়ন, বলরুম নাচগানের আয়োজন করা হতো
ঢাকার আভিজাত্যে শাহবাগের খাজা পরিবার
খাজা আবদুল গনি ঢাকায় ‘নতুন নবাব’ পরিবারের ধারা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ধনদৌলত, প্রভাব-প্রতিপত্তি, জৌলুশ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে খাজা পরিবারটিকে ঢাকার সর্বোচ্চ সামাজিক অবস্থানে নিয়ে যান।
শাহবাগের ওই বাগানবাড়িগুলো ছিল নবাবদের পারিবারিক বিলাসী জীবনযাপনের লীলাভূমি। সেখানে ঢাকার ‘এলিট’ জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি ইংরেজ সরকারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আগমন উপলক্ষে মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো। সেখানে জাঁকজমকভাবে সাহেব ও মেমদের আপ্যায়ন, বলরুম নাচগানের আয়োজন করা হতো।
খাজা পরিবার ছিল ঢাকার অভিজাত সমাজের ‘রোল মডেল’। বিত্তবান ও প্রভাবশালীদের মেলামেশা ‘পার্টি কালচার’বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিল ‘আহসান মঞ্জিল’ প্রাসাদ ও শাহবাগের সুরম্য অট্টালিকার কামরায়।
লেখক ও ঐতিহাসিক সৈয়দ মুহাম্মদ তৈফুরের ভাষায়, ‘ঢাকার সোশ্যাল পার্টির যে সূচনা ঘটে, তা মূলত শাহবাগের খাজাদের উদ্যোগে।’
শিক্ষা, উন্নত জীবন ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় শাহবাগ
পূর্ব বাংলার মানুষের, বিশেষ করে মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভাইসরয় চার্লস হার্ডিঞ্জের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল মুসলিম লীগ নেতা নবাব খাজা সলিমুল্লাহর সঙ্গে যে বৈঠক করে, সেটি ইশরাত মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে স্যার সলিমুল্লাহ পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার বিস্তারে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির উদ্যোগ নিতে বড়লাটের কাছে জোর অনুরোধ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজনীয় জমি, নগদ অর্থদানসহ নানা ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইংরেজ সরকার ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পাকিস্তান বিনির্মাণে ‘ইশরাত মঞ্জিল’

শাহবাগের ‘বাগানবাড়ি’ পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অনেক নেতার বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের জবাবে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা ‘রাজনৈতিক জমিন ও পতাকা’ তৈরির লক্ষ্যে ১৯০৬ সালের ৩০-৩১ ডিসেম্বর (মতান্তরে ২৭-২৯ ডিসেম্বর) দুই দিনব্যাপী ‘সর্বভারতীয় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন’–এর আয়োজন করা হয়। সেখানেই নতুন দল ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ গঠনের প্রস্তাব করেন খাজা সলিমুল্লাহ। এটি অনুষ্ঠিত হয় ইশরাত মঞ্জিলের বাগানবাড়িতে। এভাবেই সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে জন্ম হয় মুসলিম লীগের। তাঁকে এ কাজে সহযোগিতা করেন আগা খান, সৈয়দ আমীর আলী, সৈয়দ নবীউল্লাহ, নওয়াব ভিকার-উল-মুলক প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা
ঐতিহাসিকের জবানবন্দি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদ জানান, ‘শাহবাগে ইশরাত মঞ্জিলের জলসাঘরে (বর্তমানে মধুর ক্যানটিন) সম্মেলনের মাধ্যমে গঠন করা হয়েছিল মুসলিম লীগ। এর মাধ্যমে ভারতীয় কংগ্রেসের প্রবল প্রভাব ও আভিজাত্য অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরই পরম্পরায় ভারত ভেঙে দুই টুকরা হয়।’
অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন বলেন, অনেকে হয়তো জানেন না যে ইশরাত মঞ্জিলের সেই জলসাঘরই বর্তমান মধুর ক্যানটিন। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতারা যে গ্রুপ ছবিটি তুলেছিলেন, সেটি মধুর ক্যানটিনের সামনের অংশের জায়গা বলে জানান ড. শরীফ।

শরীফ উদ্দিন জানান, নবাবদের প্রাসাদ ছিল পুরান ঢাকায়। তবে সেসব এলাকা জনবসতি ও ঘিঞ্জি ছিল। অন্যদিকে শাহবাগ অঞ্চলটিতে ইংরেজরা থাকত। তারা নিজেদের মতো করে এলাকাটি গড়ে তুলেছিল। ঢাকার নবাবেরা চেয়েছিলেন ইংরেজদের কাছাকাছি এলাকায় একটু আরাম-আয়েশে সময় কাটাতে। কারণ, শাহবাগ, পল্টন, রমনা এলাকায় ছিল ওই সময়ের সব বিনোদনকেন্দ্র। তাই তারাও একটা সময় শাহবাগ অঞ্চলে জমি কিনে প্রাসাদ ও বাগানবাড়ি তৈরি করেন।
ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দীন আহমেদের মতে, ‘মূলত শাহবাগ বাগানবাড়ি নবাবেরা আনন্দ-ফুর্তির জন্য বানিয়েছিলেন। এখানেই স্থাপন করা হয় ইশরাত মঞ্জিল, যার সীমানা ছিল বিরাট। শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক এলাকাজুড়ে ছিল এর ব্যাপ্তি। বিংশ শতাব্দীতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এই বাড়ি বিরাট ভূমিকা পালন করে। ইশরাত মঞ্জিল পাকিস্তানেরও জন্মদাতা। তাই দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শাহবাগের জলসাঘরের ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে।’
শাহবাগ প্রাসঙ্গিক
দ্রোহ-বিদ্রোহ, প্রতিরোধ-প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে শাহবাগ এখনো জীবন্ত। শাহবাগ এখন থিসিস-অ্যান্টিথিসিসের এক ‘এজমাইলি ময়দান’।
শাহবাগকে তুলনা করা হয় লন্ডনের ‘হাইডপার্ক’-এর সঙ্গে। অর্থাৎ যে কেউ যেকোনো সময় যেকোনো বিষয়ে তাঁর মতপ্রকাশের জন্য শাহবাগে দাঁড়িয়ে যেতে পারেন। তাই তো বলা হয়, ‘শাহবাগ জেগে থাকে, শাহবাগ ঘুমায় না।’
শাহবাগ নস্টালজিয়া
শাহবাগ উপাখ্যান এ সময়ের তারুণ্যের জনপ্রিয় কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের ‘শাহবাগ’ নিয়ে একটি কবিতা দিয়ে শেষ করছি—
‘মধ্যরাত। শাহবাগের মোড়। শাহবাগের মোড়ে একজন চা বিক্রেতা।
একজন মানুষ আর দুইটা ফ্ল্যাক্সের সাথে ছয়টা কাপ
চায়ের কথা বললাম। চা খেতে খেতে হঠাৎ হাসানকে দেখতে পেলাম। শাদা চাদর গায়ে হেঁটে আসছে। আমি তাকে ডাকলাম। ছয়টা কাপ। চমকে উঠলাম। মনে পড়ল, গত বছর হাসান মারা গেছে।’
তথ্যসূত্র:
১. ঢাকা স্মৃতি বিস্তৃতির নগরী, মুনতাসীর মামুন, জুন ১৯৯৩
২. ঢাকার ৪০০ বছর, সম্পাদনা ড. এম এ হান্নান ফিরোজ, ২০০৯
৩. ঐতিহাসিক ঢাকা মহানগরী: বিবর্তন ও সম্ভাবনা, সম্পাদনা ইফতিখার-উল-আউয়াল, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ডিসেম্বর ২০০৩
৪. ঢাকার ইতিবৃত্ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, মোহাম্মদ আব্দুল কাইউম, ২০০৮
৫. ঢাকা ইতিহাস ও নগর জীবন ১৮৪০-১৯২১, শরীফ উদ্দিন আহমেদ, ২০০১
৬. Glimpses of Old Dhaka, এস এম তৈফুর, ১৯৫২
৭. দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২২ নভেম্বর ২০২৪
৮. ঢাকা কোষ, সম্পাদক শরীফ উদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১২