
ভারত-নেপাল সীমান্ত সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার মাদ্রাসা ও দখল হয়ে যাওয়া স্থাপনাকে কেন্দ্র করে অভিযান চালাচ্ছে উত্তর প্রদেশ সরকার। রাজ্য সরকারের দাবি, সরকারি জমিতে তৈরি সেসব মাদ্রাসা ও ধর্মীয় স্থানগুলোই সিল করে দেওয়া বা ভেঙে ফেলা হচ্ছে, যাদের কাছে কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই।
ওই রাজ্যের সাতটা জেলায় চালানো এই অভিযানের ফলে বহু মাদ্রাসায় পড়াশোনাও থমকে গেছে বলে অভিযোগ। রাজ্য সরকার নেপাল সীমান্তের ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত ধর্মীয় স্থান ও মাদ্রাসা পরিদর্শন করছে। সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, ১৪ই মে পর্যন্ত ২২৫টা মাদ্রাসা, ৩০টা মসজিদ, ২৫টা মাজার ও ছ'টা ঈদগাহের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
উত্তর প্রদেশের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী ওমপ্রকাশ রাজভর বিবিসিকে বলেছেন, "মাদ্রাসা খুললে সেখানে শিক্ষাদান করেন, সেটাকে হোটেল বা আবাসস্থল বানিয়ে ফেলবেন না। সেখানে বিদেশিরা এসে বাস করলে আশঙ্কা তো সৃষ্টি হবেই।"
"শিক্ষাদানের পরিবর্তে সেখানে অন্য কাজ করা হলে তার তদন্ত হবে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। যারা নিরপরাধ, যারা সেখানে শুধু শিক্ষকতা করছেন, তারা নির্ভয়ে কাজ করতে পারেন।"
কী বলছে উত্তর প্রদেশ সরকার?
উত্তর প্রদেশ সরকার সন্দেহ করছে, যথাযথ কাগজপত্র ছাড়া যেসব মাদ্রাসা চালানো হচ্ছে, সেখানে বিভিন্ন ধরনের বেআইনি কাজ হয়।
সংখ্যালঘু কল্যাণ মন্ত্রী ওমপ্রকাশ রাজভর বলেছেন, "এই রাজ্যের দু-একটা মাদ্রাসায় জাল নোট ছাপানো হচ্ছিল। সেগুলো পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে।"
তবে মাদ্রাসা সঞ্চালনকারীদের দাবি, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন।
উত্তর প্রদেশের শ্রাবস্তী জেলার বাঙ্গাইয়ের মাদ্রাসার সঞ্চালক মেরাজ আহমেদ বলেন, "এই এলাকায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মোটামুটি। তবে দারিদ্র্য খুব বেশি। মাদ্রাসায় বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়া হয় যাতে লোকে লেখাপড়া করতে পারে। কিন্তু সরকারের উদ্দেশ্য ভিন্ন।"
অন্যদিকে, সমাজবাদী পার্টির অভিযোগ- শুধু রাজনৈতিক কারণে সংখ্যালঘুদের নিশানা করছে সরকার।
সমাজবাদী পার্টির মুখপাত্র ফখরুল হাসান বলেন, "যেখানেই বিজেপি সরকার রয়েছে, সেখানেই সংখ্যালঘু এবং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিশানা করা হচ্ছে। এটা সংবিধানের লঙ্ঘন।"
সমাজবাদী পার্টির প্রধান তথা উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবও বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিযোগ তুলেছেন।
কয়েকদিন আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় তিনি বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র না থাকলে তার সমাধান অন্যভাবে হতে পারত।
পাশাপাশি, তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেছেন, যেসব মাদ্রাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বৈধ কাগজ নেই বলে এখন অভিযোগ তোলা হচ্ছে, যখন সেগুলো নির্মাণ হচ্ছিল সেই সময় কর্মকর্তারা কোথায় ছিলেন?
বাহরাইচে চিহ্নিত ৪৯৫টি স্থান
নেপালের সঙ্গে কয়েকশ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে উত্তর প্রদেশের। এটা উন্মুক্ত সীমান্ত যা পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে সশস্ত্র সীমা বল (এসএসবি)-এর ওপর।
প্রতিদিন নেপাল ও ভারতের হাজার হাজার মানুষ এই সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়া আসা করেন।
উত্তর প্রদেশের বাহরাইচ জেলা থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রূপাইডিহা সীমান্ত থেকে প্রতিদিন বহু মানুষ নেপালগঞ্জে (নেপালের একটি শহর) যাতায়াত করেন। এখানে এসএসবির তরফে শুধু পরিচয়পত্র দেখে এবং তল্লাশির পর প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
এই এলাকায় ৪৯৫টি জবরদখল করা জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এর মধ্যে ১২টার বেশি মাদ্রাসা সিল করে দেওয়া হয়েছে।
নানপাড়ার তহশিলদার অম্বিকা চৌধুরি বলেন, "রাজস্ব বিভাগের দল জমির মাপঝোঁক করছে। সরকারি জমিতে যে সমস্ত বেআইনি নির্মাণ গড়ে উঠেছিল, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।"
স্থানীয় পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে রাজস্ব ও সংখ্যালঘু বিভাগের দল প্রতিদিন পরিদর্শনের জন্য গ্রামে গ্রামে যাচ্ছে। বৈধ কাগজপত্র না থাকলে মাদ্রাসাগুলো সিল করে দেওয়া হচ্ছে।
রূপাইডিহা থেকে থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রয়েছে রঞ্জিতবোঝা গ্রাম। এই গ্রাম নেপাল সীমান্ত থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
সরকারের পক্ষ থেকে এই গ্রামের কাছে একটা নতুন অভ্যন্তরীণ বন্দরও তৈরি করেছে। পরিদর্শনের জন্য প্রশাসনের টিম স্থানীয় এক মাদ্রাসায় পৌঁছায়। সেই সময় জমির সংক্রান্ত কাগজপত্র ঠিকঠাক মিললেও জানা যায়, ওই মাদ্রাসার মাদ্রাসা স্বীকৃতি নেই। তাই সিল করার পর ওই নির্মাণের একটা অংশ ভেঙে ফেলা হয়।
মাদ্রাসার সঞ্চালক মোহাম্মদ সালমান খান বলেন, "২০১৬ সালে এই মাদ্রাসাটা চালু হয়েছিল। ২০১৭ সাল থেকে স্বীকৃতি পাচ্ছি না। স্বীকৃতি পেতে কী করব?"
সরকারি জমিতে মাদ্রাসা নির্মাণের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, "গত চার বছর ধরে আদালতে এই নিয়ে মামলা চলছে।" এই মাদ্রাসার পড়ুয়াদের মধ্যে একজন কায়সার জাহান।
বিবিসিকে ওই ছাত্রী জানিয়েছেন, বড় হয়ে চিকিৎসক হতে চান তিনি।
কায়সার জাহানের কথায়, "আমি জীববিজ্ঞান ভালোবাসি। কিন্তু মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় এখন বাড়ির কাজকর্ম করি আর ছাগল চরাই।"
প্রসঙ্গত, এই গ্রামের এক প্রান্তে আরেকটা মাদ্রাসা রয়েছে। সেই মাদ্রাসা কিন্তু প্রশাসন সিল করেনি।
বাহরাইচের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোনিকা রানীকে এই সাম্প্রতিক অভিযানের বিষয়ে জজ্ঞাসা করা হলে, তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ আধিকারিকের কথায়, "এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। প্রতিটা ধর্মীয় স্থান সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।"
তবে রাজ্য সরকারের জারি করা প্রেস নোটে অন্য কোনো ধর্মীয় ভবনের উল্লেখ নেই।
মাদ্রাসার স্বীকৃতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী ওমপ্রকাশ রাজভর বলেন, "এ নিয়ে আমরা বৈঠক করেছি। স্বীকৃতির জন্য পোর্টালটা খুব তাড়াতাড়ি চালু করার বিষয়ে সকলে সহমত হয়েছেন। যে সমস্ত মাদ্রাসার ক্ষেত্রে (নির্ধারিত) মানদণ্ড মানা হয়েছে, সেগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।"
জমুনহা ব্লকের যে মাদ্রাসা বন্ধ রয়েছে
শ্রাবস্তী জেলার জমুনহা ব্লকের বাঙ্গাই গ্রামে অবস্থিত দারুল উলুম আরাবিয়া আনোয়ারুল উলুম মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসাটা সিল করে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সরকারি জমিতে তৈরি করা হয়েছে ওই মাদ্রাসা।
শ্রাবস্তীর বাঙ্গাইস্থিত মাদ্রাসার সঞ্চালক মেরাজ আহমেদ ওই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন।
তিনি বলেন, "এই মাদ্রাসা ১৯৬০ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল এবং ১৯৬৮ সালে তা একত্রীকরণ করা হয়। আমাদের মাদ্রাসার স্বীকৃতি আছে।"
"সরকারি নথিতে স্কুল হিসেবে এর রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। মাদ্রাসা আর স্কুল আলাদা নয়। আমাদের মাদ্রাসায় ছেলে-মেয়েসহ ৩৮০ জন শিক্ষার্থী ছিল।"
তবে ১৪ই মে হাইকোর্ট থেকে স্বস্তি পেয়েছে এই মাদ্রাসা। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরই সেখানে আবার লেখাপড়া চালু হওয়া সম্ভব।
এর কিছুটা দূরে জমুনহা মাদ্রাসা বন্ধ। স্থানীয় বাসিন্দা ইসমাইলের দুই সন্তান সেখানে লেখাপড়া করত।
"আমার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ। বেসরকারি স্কুলে ফি বেশি। সেখানে কী করে আমি আমার সন্তানদের পাঠাব? এখন বাচ্চারা সারাদিন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে বেড়ায়।"
"বাড়ির কারও কথা শোনে না। মাদ্রাসায় অবৈতনিক শিক্ষা দেওয়া হতো, তাই তারা অন্তত একটু পড়াশোনা করত।"
শ্রাবস্তীর জেলাশাসক অজয় কুমার দ্বিবেদী বলেন, "ভারত-নেপাল সীমান্তের কাছে ধর্মীয় স্থলগুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যেগুলো গ্রামসভা অথবা সরকারি জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে, যেক্ষেত্রে মানদণ্ড মানা হয়নি, যাদের স্বীকৃতি নেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।"
মাদ্রাসা জরিপ
গত ২৯শে এপ্রিল উত্তর প্রদেশে জারি করা এক প্রেস নোটে উল্লেখ করা হয়, "নেপাল সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বহু অবৈধ ধর্মীয় স্থান এবং দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে স্বীকৃতি নেই এমন মাদ্রাসাগুলোকে সিল করে দেওয়া হয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এই ১৪ই মে পর্যন্ত মহারাজগঞ্জে ৪৬টা, সিদ্ধার্থনগরে ৪৩টা, বলরামপুরে ৪১টা, শ্রাবস্তীতে ১১৮টা, বাহরাইচে ২৪, লখিমপুরে ১২টা এবং পিলিভিটে একটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
নীতি কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই অঞ্চল ভারতের পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটা।
শ্রাবস্তী জেলার স্বাক্ষরতার হার ৪৬ শতাংশ। বাহরাইচের স্বাক্ষরতার হার ৪৯ শতাংশ এবং জাতীয় স্বাক্ষরতার গড় ৭৪ শতাংশ।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে রাজ্য সরকার মাদ্রাসা নিয়ে একটা সমীক্ষা চালিয়েছিল।
সেই জরিপে জানা যায়, প্রায় সাড়ে সাত হাজার মাদ্রাসা স্বীকৃতি ছাড়াই চলছে। উত্তর প্রদেশে প্রায় ১৬ হাজার ৫০০ স্বীকৃত মাদ্রাসা রয়েছে। এখানে প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। সরকারি অনুদান পায় এমন মাদ্রাসার সংখ্যা ৫৬০টা। সূত্র: বিবিসি।