
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন নাকচ করেছেন তিনি নিজেই। গতকাল আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি মিলনায়তনে একনেক সভায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান। সভার দায়িত্বশীল সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সভায় একনেক চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূস সভাপতিত্ব করেন।
একনেক সভায় প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদের অন্য একাধিক সদস্যের পদত্যাগ গুঞ্জন নিয়ে অনির্ধারিত আলোচনা হয় বলে জানা গেছে। সভায় ১৯ জন উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া গতকাল সন্ধ্যায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে।
একনেক সভার সূত্র জানান, সভায় প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য কয়েকজন উপদেষ্টার পদত্যাগ করা-না করা, জাতীয় সংসদ নির্বাচন, চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট, বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম, অর্থনৈতিক সংকট এবং উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন করার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। একনেকের নিয়মিত সভা শেষে মন্ত্রণালয়, বিভাগগুলোর সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বেরিয়ে যান। এরপর কেবল উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা বৈঠক করেন। সভা শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কথা বলেন।
সূত্র আরও জানান, সভার শুরুতে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় তিনি নিজ পদ থেকে পদত্যাগ না করার কথা বলেন। একই সঙ্গে বলেন, ‘আমরা তো এখানে নিজ থেকে দায়িত্বে আসিনি। আমাদের ছাত্ররা ডেকে এনেছেন। আর জুলাই অভ্যুত্থানে যারা প্রাণ দিয়েছেন এবং যারা এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত তাদের কথামতো আমরা দেশ পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিয়েছি। পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি আমাদের সরানোর জন্য নানান ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারাই আমাদের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছে, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা নানান খাতে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছি। এতে প্রতিনিয়ত নানা রকম প্রতিবন্ধকতা আসছে। কিন্তু সেসব প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। দেশটাকে একটা সুন্দর অবস্থানে নিতে হলে আমরা যেসব সংস্কার কার্যক্রম নিয়েছি, সেগুলো শেষ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ওপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চাপও রয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে চাপ রয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া জাতীয় সরকার গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া প্রস্তাব ও উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন নিয়েও আমাদের ওপর চাপ রয়েছে। এ নির্বাচন প্রসঙ্গে আমি আমার আগের অবস্থানের কথাই আপনাদের কাছে ব্যক্ত করছি।’ এরপর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা নানান ইস্যুতে তাঁদের মতামত একে একে তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর প্রবীণ একজন উপদেষ্টা বলেন, ‘যেহেতু ছাত্রদের আন্দোলনে স্বৈরশাসকের পতনের মাধ্যমে আমরা এ দায়িত্ব নিয়েছি, তাই ছাত্রদের অবমূল্যায়ন করা যাবে না।’ তবে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে থাকার কারণে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমকে ছাত্রদের রাজনৈতিক সংগঠন এনসিপি এবং অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখার পরামর্শ দেন এই উপদেষ্টা। অবশ্য তাঁর এ বক্তব্যের সঙ্গে আরেকজন উপদেষ্টা কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে বলেন, ‘নাহিদ ইসলাম তো আগেই পদত্যাগ করেছেন। এখন যে দুজন রয়েছেন তাঁরা তো এমনিতেই ছাত্রদের সঙ্গে সম্পর্কিত নন। তাঁরা সরকারেরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ।’ এরপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, আলোচিত-সমালোচিত মানবিক করিডর প্রসঙ্গে বক্তব্য তুলে ধরেন। সেখানে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও ঈদুল আজহায় ঘরে ফেরার প্রস্তুতির বিষয়ে কথা বলেন তিনি। এ সময় আরেকজন উপদেষ্টা বলেন, ‘ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে থাকা উপদেষ্টারা সরকারে না থাকলেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমন তো নয়।’ এসবের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘শুধু আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া কিংবা মাহফুজ আলমই নন, উপদেষ্টা পরিষদ থেকে যদি কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে চান, সেটার জন্য সবাইকে চিন্তাভাবনা করে জানানোর পরামর্শ দেওয়া হলো। তবে এটা মাথায় রাখতে হবে আমরা কিন্তু ছাত্রদের অনুরোধেই এসেছি।’ এ সময় বৈঠকে মৃদু তর্কবিতর্কের সৃষ্টি হয়।
সমাপনী বক্তব্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সব উপদেষ্টাকে ধৈর্য ধরে সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা পাবেন বলেও প্রত্যাশা করেন। এ ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন কিংবা জাতীয় সরকার গঠনের রাজনৈতিক চাপের বিষয়েও কথা বলেন তিনি। তবে যে কোনো পরিস্থিতিতে সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব সুচারুভাবে পালনের নির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের ব্রিফিং : বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা যাচ্ছেন না, তিনি চলে যাবেন বলেননি, অবশ্যই থাকছেন। আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বড় দায়িত্ব, এ দায়িত্ব ছেড়ে আমরা যেতে পারব না। আমাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমরা সে দায়িত্ব পালন করতে এসেছি।’ তিনি বলেন, ‘বড় পরিসরে আগামী নির্বাচন এবং একটা সুশাসিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য যে ধরনের ক্ষেত্র তৈরি করা দরকার, সে কাজেও কোথা থেকে কী কী প্রতিবন্ধকতা আসছে সেগুলো আমরা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি।’ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমরা আহ্বান জানাব গণ অভ্যুত্থানের সব শক্তিকে, রাষ্ট্রের সব সংস্থাকে আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করার জন্য। আমরা সব রাজনৈতিক দল, দেশের প্রশাসন, বিচার বিভাগ, বিভিন্ন সংস্থা সবাই মিলে কাজ করব। আমাদের কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য সবার সহযোগিতা চাই।’
উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতি : গতকাল বিকালে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে একটি বিবৃতি প্রদান করা হয়। বিবৃতিটি নিম্নরূপ : অর্থনৈতিক পরিষদের সভা শেষে উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অর্পিত তিনটি প্রধান দায়িত্ব (নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার) বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পরিকল্পনা কমিশনে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন সময় নানান ধরনের অযৌক্তিক দাবিদাওয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও এখতিয়ারবহির্ভূত বক্তব্য এবং কর্মসূচি দিয়ে যেভাবে স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে তোলা এবং জনমনে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় বৈঠকে। দেশ স্থিতিশীল রাখতে; নির্বাচন, বিচার ও সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে এবং চিরতরে এ দেশে স্বৈরাচারের আগমন প্রতিহত করতে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন বলে মনে করে উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য শুনবে এবং সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করবে। এতে আরও বলা হয়, শত বাধার মাঝেও গোষ্ঠীস্বার্থ উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার তার ওপর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালন অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের জনপ্রত্যাশা ধারণ করে। কিন্তু সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচারপ্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকা অর্পিত দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব করে তুললে সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।