
৩৫ বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন আগামীকাল বুধবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে প্রচারণাও। নির্বাচন ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এখন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলিয়ে ৯০৭ জন প্রার্থী এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা নানান প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রার্থীদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদে ৪১৫ জন, হল ও একটি হোস্টেল সংসদে ৪৯২ জন। কেন্দ্রীয় সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৮ জন নারী প্রার্থী ও ৩৬৬ জন পুরুষ প্রার্থী। এবারের নির্বাচনে ভোটার ২৭ হাজার ৫১৭জন। এরমধ্যে ছাত্র ভোটার ১৬ হাজার ৮৪ জন এবং ছাত্রী ভোটার ১১ হাজার ৪৩৪ জন।
নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ৬০টি কক্ষের প্রতিটিতে গড়ে ৪০০-৫০০ শিক্ষার্থী ভোট দেবেন। নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রতিটি অনুষদ ভবনের ডিনকে রিটার্নিং অফিসার এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আজ মঙ্গলবার থেকে শিক্ষার্থী ছাড়া বহিরাগত কেউ ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে পারবেন না।
ছাত্রদল ভিপি প্রার্থীর প্রতিশ্রুতি: নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্যাম্পাস
ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল থেকে ভিপি পদে লড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়। ছাত্রদল নির্বাচিত হলে তারা সন্ত্রাস ও ভয়ভীতিমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা শিক্ষার্থীদের জন্য আইনি সহায়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলছে। সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় বলেন, ‘নির্বাচনের আট দফা ইশতেহারে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ, সেশনজট নিরসন, প্রশাসনিক জটিলতা দূরীকরণ এবং আধুনিক ক্যাম্পাস গড়ার লক্ষ্য।’
কেন্দ্রীয় সংসদে ৪১৫ জন, হল ও একটি হোস্টেল সংসদে ৪৯২ জন। কেন্দ্রীয় সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৮ জন নারী প্রার্থী ও ৩৬৬ জন পুরুষ প্রার্থী। এবারের নির্বাচনে ভোটার ২৭ হাজার ৫১৭জন। এরমধ্যে ছাত্র ভোটার ১৬ হাজার ৮৪ জন এবং ছাত্রী ভোটার ১১ হাজার ৪৩৪ জন। নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ৬০টি কক্ষের প্রতিটিতে গড়ে ৪০০-৫০০ শিক্ষার্থী ভোট দেবেন।
তিনি বলেন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য ভাতা বৃদ্ধি, হলে আসন সংরক্ষণ, ব্রেইল বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গঠন করব। এছাড়া খাদ্য ও আবাসন খাতে ক্যান্টিনে ভর্তুকি বৃদ্ধি, খাবারের মান যাচাই কমিটি গঠন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক ক্যাম্পাসে রূপান্তর করার কথা বলেছে এ নেতা। তাদের লক্ষ্য, ‘প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি সিট, একটি পড়ার টেবিল’ নিশ্চিত করা।
নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ফোকাস রাখার কথা বলেছেন এই নেতা। ছাত্রদল তাদের ইশতেহারে নারীদের পোশাক ও চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; যৌন হয়রানি প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স; প্রতি হলে স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন; নারী চিকিৎসক এবং নিরাপদ কমনরুম সুবিধা; ইনডোর স্পোর্টস সুবিধা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ছাত্রদলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল সাংগঠনিক দুর্বলতা। পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় এবং সংগঠনের ভেতরে মতবিরোধ থাকার কারণে, অনেক প্রার্থী শিক্ষার্থীদের কাছে অপরিচিত। এছাড়া গত রবিবার সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগের কারণে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে সংগঠনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুন উর রশীদ মামুনকে। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের মধ্যে এক ধরনের কোন্দলও দেখা গেছে।
হৃদয় আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শতভাগ আবাসনের ব্যবস্থা করতে চাই। ভর্তির প্রথম দিন থেকেই প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য একটি আসন ও একটি পড়ার টেবিল নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, শাটল ট্রেনে বগি সংকট, পাওয়ার কার বিকল—এগুলোও সমাধান করতে হবে।’ শহর ও উপজেলা পর্যায়ে বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেছেন তিনি।
শিক্ষার্থীদের আমানত রক্ষা করার অঙ্গীকার শিবির প্যানেলের ভিপি প্রার্থী রনির
ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ৯টি ফোকাস পয়েন্ট দিয়ে ইশতেহার ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি তারা আরও ৩৩টি দফা দিয়েছে। এর মধ্যে নিয়মিত চাকসু নির্বাচন নিশ্চিতকরণ, নিরাপদ বাস সার্ভিস চালু, সেশনজট নিরসন, কটেজ-মেসে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের সুবিধা বৃদ্ধি, ফ্যাসিবাদমুক্ত ক্যাম্পাস গঠনের কথা বলা হয়েছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি ও নারীবান্ধব কমনরুম চালু, নিরাপদ ও গ্রিন ক্যাম্পাস নির্মাণ, সব জাতিগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, লিগ্যাল এইড সেল গঠনের মতো প্রতিশ্রুতিও রয়েছে।
প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ইব্রাহিম হোসেন রনি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। এছাড়া চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণ শিবিরের সভাপতি। তিনি বলেন, ‘এখানে বিভিন্ন মত, পথ ও চিন্তার শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। আমি নির্বাচিত হলে একটি স্বাস্থ্যসম্মত ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে কাজ করব। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব, পরিবেশ দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেব এবং শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখব।’
চাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধি বেছে নেয়। নির্বাচিত হলে প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক আরও মজবুত করব। প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করব।’
অন্যান্য প্যানেল বা প্রার্থীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে রনি বলেন, ‘আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা আমার প্রতিপক্ষ নয়; তারা আমার সহপাঠী ও বন্ধু। আমরা সবাই মিলেমিশে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে কাজ করতে চাই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই ক্যাম্পাসকে শিক্ষার্থীদের যাতায়াত ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ নেব। ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত সিসিটিভি স্থাপন, রাস্তার বাতি মেরামত, আবর্জনামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত এবং নারীদের নিরাপত্তা জোরদারে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই চাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃত নেতৃত্বের বিকাশ ঘটুক। ছাত্রসমাজ যেন তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। নির্বাচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে প্রশাসনিক সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেব। শিক্ষার্থীদের জন্য সহজলভ্য প্রশাসনিক সেবা নিশ্চিত করব। আমার অঙ্গীকার হলো— আমি কোনো প্রভাব বা চাপের কাছে নতি স্বীকার করব না। শিক্ষার্থীদের ভোটই আমার শক্তি, আর আমি সেই ভোটের আমানত রক্ষা করব।’
শিক্ষার্থীদের বিভাজন দূর করতে চান মাহফুজুর রহমান
‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেলে ভিপি পদে লড়বেন মাহফুজুর রহমান। তিনি ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) যুগ্ম আহবায়ক। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির অভিযোগ তুলে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) থেকে সরে এসে স্বতন্ত্র প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানান প্যানেলের প্রার্থীরা।
মাহফুজ বলেন, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় ও সমস্যা সমাধানই তার প্রধান লক্ষ্য। তিনি মনে করেন, চাকসু শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবহন সংকট, আবাসন সমস্যা ও শিক্ষার পরিবেশকে অগ্রাধিকার দেবেন এবং নির্বাচিত হলে শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে এসব সমস্যার সমাধানে কাজ করবেন।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা জরুরি। ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের অনিয়ম, বৈষম্য বা ভীতিকর পরিবেশ যেন না থাকে—সেটি নিশ্চিত করতে তিনি উদ্যোগ নেবেন। মাহফুজ নির্বাচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া বিভাজন দূর করে একত্রিত, ঐক্যবদ্ধ ক্যাম্পাস গঠনে মনোযোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন।