Image description
 

সিলেট–২ আসনের রাজনীতি এখন বিএনপির ভেতরে এক অঘোষিত শক্তি–পরীক্ষার ময়দানে পরিণত হয়েছে।

 
 

একদিকে আছেন নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা, যিনি ইলিয়াসের স্মৃতি ও তৃণমূলের আবেগকে রাজনৈতিক মূলধন হিসেবে ধারণ করে মাঠে আছেন বহু বছর ধরে। অন্যদিকে রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির, যিনি প্রবাসে থেকেও কেন্দ্রীয় প্রভাব ও আন্তর্জাতিক সংযোগের কারণে দলের উচ্চপর্যায়ে আস্থাভাজন।

 

 

দু'জনেই এখন আসনটির মনোনয়ন প্রত্যাশী। ফলাফল— মাঠ থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত এক জটিল রাজনৈতিক ভারসাম্যের লড়াই।

 

ইলিয়াস আলীর উত্তরাধিকার ও লুনার আবেগময় নেতৃত্ব ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার পর দীর্ঘদিন সিলেট–২ আসনের বিএনপি রাজনীতিতে এককভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাহসিনা রুশদীর লুনা। মাঠপর্যায়ে তিনি ছিলেন সংগঠনের মুখ ও প্রতীক। দরিদ্রদের সহায়তা, শিক্ষার্থীদের উপকরণ বিতরণ, নারীর ক্ষমতায়নমূলক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ— এসব কর্মকাণ্ডে তিনি তৃণমূলের আস্থা অর্জন করেছেন।

 

 

ইলিয়াসের অনুপস্থিতিতে তার নামেই আবেগ ও সহানুভূতি রাজনীতির বড় চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আবেগভিত্তিক নেতৃত্ব এখন বাস্তবতার চ্যালেঞ্জে পড়েছে। লুনার কিছু সিদ্ধান্ত—বিশেষ করে স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন বিতর্কিত নেতাকে ঘিরে গঠিত অবস্থান—তৃণমূলে ক্ষোভ তৈরি করেছে।

 

দলের ভেতর অনেকে মনে করেন, তিনি কিছু সিদ্ধান্ত যাচাই না করেই নিয়েছেন, যার ফলে নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদের একাংশ হুমায়ুন কবিরের বলয়ে সরে যাচ্ছেন।

 

 

 

কেন্দ্রীয় আস্থা, কিন্তু স্থানীয় দূরত্ব— হুমায়ুন কবিরের অবস্থান অন্যদিকে হুমায়ুন কবির দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকলেও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তার অবস্থান শক্তিশালী। বিএনপির আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মুখ হিসেবে তিনি বিভিন্ন ফোরামে দলের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন, বিদেশে লবিং করেছেন এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণে প্রভাব রেখেছেন।

তবে তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা মাঠের রাজনীতি। স্থানীয় পর্যায়ে উপস্থিতি সীমিত থাকায় অনেকে তাকে ‘কেন্দ্রীয়ভাবে শক্ত কিন্তু মাঠে দুর্বল’ নেতা হিসেবে দেখছেন।

 

 

দলীয় সূত্র বলছে, তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন স্থানীয় নেতা অতীতে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। ফলে দলে বিভাজন আরও গভীর হচ্ছে। আবার অনেকেই মনে করেন— বহিষ্কৃতদের বলয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে, তিনি পুনর্গঠনমূলক ভূমিকা নিতে পারলে মাঠে অবস্থান মজবুত করতে পারতেন।

 

সংঘর্ষ, বিভাজন ও পারস্পরিক সন্দেহ এই দুই বলয়ের দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্যে।

গত ৯ অক্টোবর রাতে বিশ্বনাথ পৌর শহরে লুনা ও হুমায়ুন সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হন। পরদিন উভয় পক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে একে অপরকে দোষারোপ করে।

 

হুমায়ুন কবিরের বক্তব্য—‘কেঁচকি–পুটির ভয় দেখিয়ে আমাকেও মাঠ ছাড়া করা যাবে না’—সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়, যা লুনা সমর্থকদের কাছে উস্কানিমূলক মনে হয়েছে।

 

দলের কেন্দ্রীয় দফতর পরদিনই নির্দেশ দেয়— উভয়পক্ষ সংযত থেকে ৩১ দফার আন্দোলনমূলক কর্মসূচিতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে। কিন্তু স্থানীয় বাস্তবতা বলছে, সেই ঐক্য এখন কাগজে–কলমেই সীমাবদ্ধ।

 

দীর্ঘদিন গোয়েন্দা রিপোর্টে লুনাকেই সিলেট–২ আসনের একক শক্তি হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলোতে মাঠপর্যায়ে তার জনপ্রিয়তা কমে আসার ইঙ্গিত রয়েছে, বিপরীতে হুমায়ুন কবিরকে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ‘লুনার ডান–বাম ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতার নেতিবাচক আচরণ ও সিদ্ধান্তই তার ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।’

 

 

এদিকে, দলের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে— যে শূন্যতা ইলিয়াস আলী রেখে গেছেন, সেটি লুনা আংশিকভাবে পূরণ করতে পেরেছিলেন, কিন্তু হুমায়ুন কবিরের কেন্দ্রীয় প্রভাব ও ‘উচ্চপর্যায়ের আস্থা’ এখন সেই ভারসাম্যকে নড়বড়ে করে তুলেছে।

 

সিলেট–২ আসনের রাজনীতি এখন এক দ্বিমাত্রিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে।

মাঠে লুনা আছেন আবেগ, তৃণমূল ও সহানুভূতির প্রতিনিধিত্বে আর কেন্দ্রে হুমায়ুন কবির আছেন ক্ষমতার সংযোগ, প্রভাব ও নীতিনির্ধারণের অংশীদারিত্বে।

কেউ একা সম্পূর্ণ শক্তিশালী নন, আবার কেউ পুরোপুরি দুর্বলও নন। এই ভারসাম্যের রাজনীতিই আসনটিকে করেছে সবচেয়ে আলোচিত ও অনিশ্চিত।

 

একজন স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ভাষায়—‘ইলিয়াস আলীর অনুপস্থিতিতে লুনা ছিলেন প্রতীক, আর হুমায়ুন কবির হচ্ছেন কৌশল। এখন বিএনপির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে— তারা কাকে বেছে নেবেন।