Image description

রাজধানীর শাহবাগের বারডেম হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটির ১৬ তলার করিডোরে পা রাখতেই দেখা গেল কিছু তরুণের মুখ। তাদের চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাস, হাসিতে ছিল স্বপ্ন। ইউনিফর্মে পরিহিত এই নার্সিং শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন অকপটে জানালেন, তাদের প্রাত্যহিক বাস্তবতা আর আশা-অভিমানের গল্প। তারা সবাই বারডেম নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী। 

এ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সাঞ্জানা বলেন, ‘এখানে কিছু শিক্ষক কো-অপারেটিভ ও সাপোর্টিভ, তারা আমাদের শিক্ষাদানে ভালোভাবে সহযোগিতা করে। তবে, সবাই একরকম নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘নার্সিং শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জায়গায় হিউমিলেটেড এর শিকার হয়। নার্সিং সেক্টরে হিজাব নিয়ে একটি বড় ইস্যু রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, হিজাব পরলে পেশেন্টরা ভয় পায়।’

‘হিজাব পরলে ছোট করে পরতে হবে এবং কাজ ঠিকভাবে করা যাবে না। কিন্তু, হিজাব পরা কোন বাধ্যবাধকতা নয়। অন্য জায়গায় কি হচ্ছে তা জানি না, তবে আমাদের এখানে হিজাব পরলে কিছু প্রশ্ন ওঠে।’

 

‘আমাদের প্রতি শিক্ষকদের কোনো অবহেলা নেই। তাদের পারসোনাল শিট থাকে, সেখান থেকে তারা আমাদের পাঠদান করে। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের পাঠদানে ঘাটতি রয়েছে। আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও উন্নতির আশা করি’- তিনি যোগ করেন। 

কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মারিয়াম বলেন, ‘আমার মনে হয়, নার্সিং সেক্টর অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় বেশ ভিন্ন। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে এসে পড়াশোনা করছে। বিশেষ করে, অনেকেই বাংলা মিডিয়াম থেকে এসেছে, অথচ এখানে সম্পূর্ণ ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো হয়। শুরুতে এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছিল, তবে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক লাগছে। যদিও আমি আমার নার্সিং অ্যাকাডেমিক স্টাডি নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই, তবুও সামগ্রিকভাবে অভিজ্ঞতাটা ভালো। তবে আমি মনে করি, ক্লিনিক্যাল শিক্ষার ক্ষেত্রে আরও বেশি নার্সিং-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন।’

তাদের সফলতা
শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা এখানে সবাই গ্র্যাজুয়েট নার্স। এখান থেকে আমরা ভবিষ্যতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ পাব। দেশীয় পর্যায়ে যেমন বিভিন্ন হাসপাতালে তেমনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও নিজেদের অবস্থান গড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের অনেকেরই ঝোঁক থাকে বিদেশে গিয়ে কাজ করার, তবে সেই জায়গাতেও আমরা অনেকাংশে পিছিয়ে আছি।’

 

তারা আরও বলেন, ‘যদি ভারতে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার নার্স তৈরি করা সম্ভব হয়,তাহলে আমরা পিছিয়ে কেন? ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশের পক্ষ থেকে মাত্র ৫% নার্স বিদেশে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। এমনকি কিছুদিন আগে কাতার ও সৌদি আরবের মতো দেশ নার্স চেয়েছিল কিন্তু আমরা তাদের প্রয়োজনীয় সংখ্যক নার্স সরবরাহ করতে পারিনি। এটি আমাদের জন্য দুঃখজনক হলেও বাস্তব চিত্র। উন্নত প্রশিক্ষণ ও কাঠামোগত উন্নয়ন ঘটলে এ ক্ষেত্রে আমাদের সম্ভাবনা অনেক।’

অ্যাকাডেমিক সিলেবাস
শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের একাডেমিক সিলেবাস খুবই ভালো এবং আন্তর্জাতিক মানের কারিকুলামের সাথে সংগতিপূর্ণ। আমাদের সিলেবাস বাহিরের কারিকুলামের সঙ্গে সমন্বিতভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যা শিক্ষার মানকে আরও উচ্চতর করতে সহায়তা করছে। সিলেবাসে কোনো সমস্যা নেই, এবং এটি আমাদের নার্সিং শিক্ষার জন্য অত্যন্ত উপযোগী।

 

তবে, সমস্যা মূলত প্রশাসনের দিকে। প্রশাসনের যথাযথ সুদৃষ্টি এবং কার্যকরী ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের সিলেবাসের সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং মনোযোগের অভাবে শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখা কিছুটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

নার্সিং শিক্ষার চ্যালেঞ্জ
নার্সিং শিক্ষার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, বাংলাদেশে নার্সিং শিক্ষার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো—উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা। একটি মানসম্পন্ন নার্স তৈরির জন্য থিওরি, ল্যাব এবং ক্লিনিক্যাল—এই তিনটি শিক্ষাধারার সমন্বয় থাকা জরুরি। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো, অধিকাংশ নার্সিং কলেজেই এই কাঠামোগত শিক্ষার যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানেই থিওরিটিক্যাল পাঠদানের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, এমনকি বিষয়ভিত্তিক কোনো বিশেষজ্ঞ শিক্ষকও নিযুক্ত করা হয় না।

এছাড়া যেসব শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তা মূলত হাসপাতাল-নির্ভর এবং অনেক ক্ষেত্রে শুধু প্র্যাকটিক্যাল কাজকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা পূর্ণাঙ্গ তাত্ত্বিক ও গবেষণাভিত্তিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়। ল্যাব সুবিধার অভাব, শিক্ষক সংকট এবং প্রশিক্ষণের দুর্বল কাঠামো সারাদেশের নার্সিং কলেজগুলোতে একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই অব্যবস্থাপনা এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নার্সিং পেশায় শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করছে কিন্তু তাদের সক্ষমতা এবং দক্ষতা গড়ে তোলার জন্য যেই সহায়ক পরিবেশ প্রয়োজন—তা অধিকাংশ কলেজে অনুপস্থিত। ফলে পেশাগত জীবনে প্রবেশের আগেই তারা এক ধরনের অসম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামছে যা দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

প্লেসমেন্ট সুবিধা
বারডেম নার্সিং কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষা তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে: থিওরিটিক্যাল, ল্যাব, এবং ক্লিনিক। তবে, ক্লিনিক্যাল প্লেসমেন্ট মূলত শিক্ষার জন্যই করা হয়। সেখানে গ্রুপওয়াইজ শিক্ষাদান করা হয় যেখানে একাধিক শিক্ষার্থী থাকে এবং একজন শিক্ষক তাদের পরিচালনা করেন। প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে একজন করে শিক্ষার্থী দেওয়া হয় এবং ওখানকার স্টাফদের সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করার জন্য শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু একটি সমস্যা হচ্ছে, ধরুন আমি বার্নের থিওরি পড়ছি। কিন্তু বার্ন পেশেন্ট পাচ্ছি না বা অন্য বিভাগের পেশেন্ট নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে যা একটি চ্যালেঞ্জ।’

ড্রেসকোড সমস্যা
বারডেম নার্সিং কলেজের নারী শিক্ষার্থীরা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে জানান, ‘আমরা যে ড্রেসটি পরিধান করি, সেই কারণে অনেকেই আমাদের ‘সিস্টারস’ বা ‘ব্রাদারস’ বলে সম্বোধন করে। কিন্তু আমরা এই ধরনের সম্বোধনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। কারণ বিদেশে নার্সদের এমনভাবে ডাকা হয় না—তাদের শুধুই ‘নার্স’ বলে সম্বোধন করা হয়।’

 

তারা বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের পেশাটিকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হোক এবং ‘নার্স’ নামেই ডাকা হোক। কারণ এই শব্দটি পেশাগত পরিচয় ও মর্যাদাকে প্রতিনিধিত্ব করে। ‘সিসটার’ বা ‘ব্রাদার’ বলার মাধ্যমে নার্সদের পরিচয় এবং পেশার গুরুত্ব অনেক সময় আড়াল পড়ে যায়। এটি শুধুই একটি পোশাকের বিষয় নয় বরং পেশাগত সম্মান ও স্বীকৃতির বিষয়। তাই নার্সিং পেশার মর্যাদা ও গুরুত্ব বজায় রাখতে 'নার্স' বলেই সম্বোধন করা অত্যন্ত জরুরি।’

শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ 
শিক্ষার্থীরা এ সময় শিক্ষাখাতে বাণিজ্যিকীকরণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, কিছু হাসপাতাল নার্সিং শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে পুরো প্রতিষ্ঠান চালানোর কৌশল নেয়। আমাদের থিওরির পাশাপাশি প্র্যাকটিক্যাল ল্যাবের সুযোগ থাকা জরুরি, অথচ অনেক নার্সিং কলেজেই ল্যাব সুবিধা নেই। চাকরির দিক থেকে বললে, নার্সদের ৯ম গ্রেডের চাকরি মিলছে না যা হতাশাজনক।

নার্সিং সেক্টরের বড় একটি সমস্যা হলো—শিক্ষাকে ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন ব্যাঙের ছাতার মতো নার্সিং কলেজ গজিয়ে উঠেছে। পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালে আমরা তাদের সংগঠিত ও সফল নার্সিং ব্যবস্থার একটি পরিষ্কার চিত্র পাই। অথচ আমাদের দেশে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মাত্র ২টি প্রতিষ্ঠান বা মালিকের মাধ্যমে প্রায় ৫৯টি নার্সিং কলেজ পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ৩৫৪টিরও বেশি নার্সিং কলেজ রয়েছে। যার অধিকাংশই বেসরকারি খাতে পরিচালিত ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যপ্রসূত।’

ভাড়ায় শিক্ষাকার্যক্রম
কলেজের শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘বর্তমানে অনেক নার্সিং কলেজ রয়েছে যাদের নিজস্ব একাডেমিক অবকাঠামো কিংবা আবাসনের (অ্যাকমোডেশন) সুবিধা নেই। তারা সাধারণত কোনো দোকানঘর বা ছোট জায়গা ভাড়া করে সেখানেই শিক্ষা কার্যক্রম চালায়। অনেক কলেজে স্থায়ী শিক্ষক নেই, বাইরে থেকে শিক্ষক ভাড়া করে এনে পাঠদান করানো হয়। এমনকি নতুন যারা গ্র্যাজুয়েট, তাদের দিয়েই পাঠদান করা হচ্ছে। অথচ নার্সিং কলেজগুলাতে আমাদের মানসম্মত শিক্ষা পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।’

নার্সিংকে বাণিজ্যিকীকরণ 
শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘কিছু হাসপাতাল নার্সিং শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে পুরো প্রতিষ্ঠান চালানোর কৌশল নেয়। যেখানে থিওরির পাশাপাশি প্র্যাকটিক্যাল ল্যাবের সুযোগ থাকা জরুরি, অথচ অনেক নার্সিং কলেজেই ল্যাব সুবিধা নেই। চাকরির দিক থেকে বললে, নার্সদের ৯ম গ্রেডের চাকরি মিলছে না যা হতাশাজনক। নার্সিং সেক্টরের বড় একটি সমস্যা হলো—শিক্ষাকে ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন ব্যাঙের ছাতার মতো নার্সিং কলেজ গজিয়ে উঠেছে। পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালে তাদের সংগঠিত ও সফল নার্সিং ব্যবস্থার একটি পরিষ্কার চিত্র পাই। অথচ আমাদের দেশে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মাত্র ২টি প্রতিষ্ঠান বা মালিকের মাধ্যমে প্রায় ৫৯টি নার্সিং কলেজ পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ৩৫৪টিরও বেশি নার্সিং কলেজ রয়েছে। যার অধিকাংশই বেসরকারি খাতে পরিচালিত ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যপ্রসূত।’

 

কলেজ আ্যকাডেমিশিয়ানের অভিমত
বারডেম নার্সিং কলেজের অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর ঝর্ণা রানী দাস আ্যকাডেমিক পরিবেশ ও অবকাঠামো নিয়ে বলেন, ‘আমাদের এখানে অ্যাকমোডেশন (আবাসন) খুবই খারাপ অবস্থা। তবে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের কিভাবে ভালোভাবে রাখব, তার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। এখানে বর্তমানে দুটি বিভাগ রয়েছে এবং আমাদের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩০০ জন কিন্তু শিক্ষকসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে এখনও পর্যন্ত কোন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তবে শিগগির শিক্ষক সরবরাহ করা হবে বলে আশ্বাস রয়েছে। বর্তমানে আমাদের কলেজে কোনো প্রিন্সিপাল নেই তবে দুটি অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর রয়েছেন।’

এছাড়া ঝর্ণা রানী দাস বলেন, "লেকচারার ৮টি পোস্ট থাকলেও এখানে মাত্র ৪ জন লেকচারার আছেন। ইনস্ট্রাক্টরের ৬টি পোস্টে বর্তমানে ২ জন আছেন এবং ৪টি পোস্ট শূন্য রয়েছে। এখানের ক্লাসরুমগুলো আরও বেশি কমফোর্টেবল হলে শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো হত।’

তিনি আরও জানান, ‘মূলত আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম হাসপাতালের উপরে শুরু হয়েছে এবং তাই অ্যাকমোডেশন সমস্যা কিছুটা রয়েছে। তবে আমাদের বাসভবনে জায়গা রয়েছে এবং সেখানে ৩০ তলা বিল্ডিং নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে যা শিক্ষার পরিবেশ অনেকটাই উন্নত করতে সাহায্য করবে।’