সম্প্রতি কয়েক দফায় ভূমিকম্পের পর বন্ধ ঘোষণা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অন্তত আগামী ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সশরীর কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। গত ২২ নভেম্বর জরুরি সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের এ সিদ্ধান্ত হয়। পরদিন বিকেল পাঁচটার মধ্যে আবাসিক হল ছাড়ার নির্দেশও দেওয়া হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের অনেকেই অবস্থান করছেন। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, ঝুঁকি বিবেচনায় নয়, বরং শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সামাল দিতেই হল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা এসেছে।
২১ তারিখ আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভূমিকম্পের সময় হলের ঝুকিপূর্ণতার কথা বিবেচনা করে শিক্ষার্থীরা পলাশিতে অবস্থিত কর্মচারী ভবনে অবস্থান নেন। পরে কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রীরা এসে এই ভবনে আশ্রয় নেন।
ওই সময় শিক্ষার্থীরা জানান তাঁদের হল সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের কর্মচারী ভবনে থাকতে দিতে হবে। প্রশাসন জানায় তাদের এখানে কিছু করার নেই। পরপর দুইদিন ভূমিকম্প হওয়ায় প্রশাসন ২৩ তারিখ বিকাল ৫টার মধ্যে হলগুলোর ঝুকিপূর্ণতার কারণ দেখিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে জরুরি ভিত্তিতে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। একদল শিক্ষার্থী এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের অসন্তোষের কথা জানান দেন এবং ছেলে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ হলে থেকে যায়।
২০২০-২১ সেশনের মুহসীন হলের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী হুসাইন বলেন, 'সবারই নিজেদের মতো প্ল্যান ছিল। যার ফলে হল বন্ধ করলেও চলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আমার মিডটার্ম পরীক্ষা ছিল পরের দিনই, বন্ধের ঘোষণায় সবারই একাডেমিক প্ল্যানে পরিবর্তন হয়েছে। আমিও হলে থেকে গেছি। কিন্তু এখন অনেক ছাত্রনেতাকেই দেখা যাচ্ছে তারা নির্বাচনী প্রচারণা করে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন এলাকাতে। সে জন্য শিক্ষার্থীরা সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করছে যে বিশেষ উদ্দেশ্যেই ক্যাম্পাস বন্ধ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু তাঁদের কার্যক্রম অত্যন্ত স্পষ্ট , তাই আমার কাছে মনে হচ্ছে এটার পিছনে অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে।'
এই বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোষাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও সহ-উপাচার্য ড. মামুন আহমেদ বলেন, 'এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মুখপাত্র সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) বলতে পারবেন।' কিন্তু সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশাকে ছয়বার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
জাতীয় ছাত্র শক্তি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই বিষয়কে কেন্দ্র করে ২৩ নভেম্বর একটি বিবৃতি প্রদান করে। সেখানে তারা প্রশাসনের হল সংস্কারের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালেও কয়েকটি বিষয় নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের নোটিশে হল খালি করার নির্দেশে তারা আপত্তি জানিয়েছে। মেয়েদের হলগুলো জোরপূর্বক খালি করার সিদ্ধান্তেও তারা আপত্তি জানায়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলাতে সরব হয়ে উঠেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাঁরা অনেকে হলত্যাগ না করে থেকে গেছেন হলে। মেয়েদের হলে ছাত্রীসংখ্যা হিসাব করে চালু করা হয়েছে ক্যান্টিন।
জাতীয় ছাত্রশক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক আলামিন সরকার স্ট্রিমকে বলেন, 'এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক বলার কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। মুহসীন হলের শিক্ষার্থীরা কর্মচারী ভবনের ফাঁকা জায়গাগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার পর দেখা গেছে প্রশাসন সরব হয়ে উঠেছে। এখানের রাজনীতিটা হলো, কর্মচারীরা অধিকাংশই ঢাকার ভোটার। প্রশাসন চাইলেই জহুরুল হক হলের কর্মচারী ভবনে ঝুকিপূর্ণ হলগুলোর শিক্ষার্থীদের আবাসনের বিকল্প ব্যবস্থা করেতে পারে, কিন্তু তার বদলে দিয়াবাড়িতে ছাত্রদের রাখার ব্যবস্থা যৌক্তিক নয়। মূলত কর্মচারী ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য এই ব্যবস্থা।'
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন স্ট্রিমকে বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের নানান এলাকা থেকে ঢাকায় আসেন শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে। সেই উদ্দেশ্যটাই বাজেভাবে ব্যহত হয় বারবার। এমনিতেই করোনা ও জুলাই আন্দোলনের সময়টা মিলে বড় গ্যাপ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ক্যালেন্ডারে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের মতো যেসব সমস্যা প্রশাসনের আন্তরিক ও তড়িৎ পদক্ষেপ থাকলে অতি সহজেই সমাধানযোগ্য ছিলো সেসবের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়াকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থন করে না।
নাসির উদ্দিন আরও বলেন, ঢাবি ছাত্রদল হল সংস্কার বিষয়ে ৫ আগস্টের পরে একাধিক স্মারকলিপি প্রদান করলেও তখন প্রশাসন পদক্ষেপ নেয়নি। এখন ১৫ দিনের বন্ধে সব কিছু জাদুবলে তো ঠিক করা সম্ভব না। তথাকথিত ডাকসু প্রতিনিধিরা এ সময়টাতে আবাসিক হলের নির্মাণকাজ কিংবা থেকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থেকে দলীয় নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্ত হচ্ছেন। এসব খুবই দৃষ্টিকটুভাবে সবার চোখেই ধরা পড়ছে এবং স্বাভাবিকভাবেই সহজ বিকল্প থাকা স্বত্বেও হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সঙ্গে রাজনৈতিক এসব কার্যক্রমের সম্পর্কও কমবেশি বোঝা যাচ্ছে বলে মনে করি।'
উল্লেখ্য গত ২১ ও ২২ নভেম্বর দেশজুড়ে ভূমিকম্পের পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী আহত হন। হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের ও বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের শিক্ষার্থীরা পলাশিতে অবস্থিত কর্মচারী ভবনের ফাঁকা কক্ষগুলোতে আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে ২২ তারিখ প্রশাসন অনলাইন মিটিং করে ২৩ তারিখের মধ্যে জরুরিভাবে আবাসিক হলগুলো খালি করার নির্দেশ দেয়। অনেক শিক্ষার্থী জরুরিভাবে হল ত্যাগ করলেও হলে থেকে গেছেন বেশ কিছু শিক্ষার্থীরা।