Image description

আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে রমজানের আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের টাইমফ্রেম বেঁধে দেয়া হয়েছে। রোজার আগে নির্বাচনের লক্ষ্যে আগামী ডিসেম্বরে তফসিল ঘোষণা দিতেই নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ইতোমধ্যে তিনশ আসনের সীমানা এবং ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন ঘিড়ে যখন প্রস্তুতি চলছে তখন তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নিয়ে ক্যাম্পাস সরগরম হলেও সাধারণ মানুষের এই ভোট নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। ধারণা করা হয়েছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন নিয়ে রাজধানীবাসীসহ সারাদেশের মানুষের মধ্যে আগ্রহ বাড়বে। কিন্তু ক্যাম্পাসের বাইরে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণার তোলপাড় ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ভোট নিয়ে আলোচনা ও আগ্রহের সৃষ্টি হয়নি। এমনকি অর্ধশত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ডাকসু নির্বাচন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেটার প্রতি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ থাকতে পারে, তবে এ নিয়ে আমাদের তেমন আগ্রহ নেই। আর ওই নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারবে এমনও নয়। ওটা নিছক বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির নির্বাচন। তবে এটা ঠিক ডাকসু নির্বাচন নিয়ে বট বাহিনী তথা (স্বয়ংক্রিয় বা আধা-স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার (বট) দ্বারা পরিচালিত অনলাইন অ্যাকাউন্টগুলোয় শোরগোল চলছে। কিছু গণমাধ্যমও ডাকসু নির্বাচনের ঢেউ সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা মানুষের মধ্যে তেমন প্রভাব ফেলতে পারছে না। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক পাল্লায় মাপা ঠিক নয়। ডাকসু-জাকসু-রাকসু নির্বাচন ক্যাম্পাস সরগরম হলেও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়নি; ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে শিক্ষাঙ্গনের ভোটের ফলাফলের প্রভাব তেমন পড়বে না।

জানতে চাইলে ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় নির্বাচনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। বরং, ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ছাত্র রাজনীতির ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অতীতেও জাতীয় নির্বাচনের ওপর ডাকসুর ফলাফল এমন কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি।

বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল আগামী জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন। তিনি বলেন, অনেকদিন পর ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে, আমি এটিকে স্বাগত জানাই। ডাকসু নির্বাচন ছাত্র রাজনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব তৈরি করে। তবে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় নির্বাচনের ওপর প্রভাব ফেলে না। এবারের ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলও আগামী জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। গণদলের সভাপতি এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরী বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ নেই। ক্যাম্পাস কেন্দ্রীক এ নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না। মানুষ জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। রাজধানী ঢাকার অনেক কর্মজীবী মানুষ জানেন না ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব নির্বাচন নিয়ে শোরগোল হলেও জাতীয় নির্বাচনে এর ছিঁটেফোটাও প্রভাব পড়বে না।

ইনকিলাবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদদাতা জানান, আগামী ৯ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের দিন নির্ধারণ করে গত ২৯ জুলাই তফসিল ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তফসিল অনুযায়ী ১২ থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত মনোনয়ন বিতরণ করা হয় এবং ১৯ আগস্ট পর্যন্ত মনোনয়ন জমা নেওয়া হয়। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল প্যানেল, ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের’ প্যানেল, বামদলগুলোর ইমি ও বসুর নেতৃত্বে ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেল, কাদের-বাকেরের নেতৃত্বে ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল, এনসিপি নেতা মাহিনের নেতৃত্বে ‘ডিইউ ফার্স্ট’ নামে স্বতন্ত্র প্যানেল, উমামা ফাতেমার নেতৃত্বে স্বতন্ত্র প্যানেল, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের প্যানেল, ছাত্র অধিকার পরিষদের ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’ প্যানেল, বামপন্থী তিন সংগঠনের নেতৃত্বে প্যানেল, জুবায়ের-মোসাদ্দেকদের আংশিক স্বতন্ত্র প্যানেলসহ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন অনেকেই। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা হলে হলে যাচ্ছেন এবং ভোটারদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চাচ্ছেন। এর বাইরে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের পক্ষ্যে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও প্যানেলের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

ইনকিলাবের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা জানান, জাকসু নির্বাচন হবে ১১ সেপ্টেম্বর। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) হল সংসদ নির্বাচনে ১০২ জন প্রার্থীর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এ ছাড়া হল সংসদের ৬৩টি পদে কোনো প্রার্থী নেই। ফলে এসব পদ শূন্য বলে বিবেচিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ২১টি আবাসিক হলে ১৫টি করে পদ রয়েছে। ক্যাম্পাসে নির্বাচনী প্রচারণা চললেও ভোটারদের মধ্যেই তেমন উদ্দীপনা নেই। কারণ অনেকগুলো হলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তবে জাকসুতে ২৫টি পদে ১৭৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন। এর মধ্যে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে ১০ ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নয় জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হলেও ক্যাম্পাসের বাইরে তেমন আলোচনা নেই।

ইনকিলাবের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা জানান, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ এবং সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের তারিখ ২৮ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করেছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী, ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মনোনয়ন জমা, মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ৮ এবং ৯ সেপ্টেম্বর, প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ ১১ সেপ্টেম্বর এবং মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৫ সেপ্টেম্বর, প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে ১৬ সেপ্টেম্বর। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর একাডেমিক ভবনে ভোট গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরো জানান, রাকসু নির্বাচন নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রচারণা দেখা গেলেও রাজশাহী শহরের মানুষের মধ্যে রাকসু নির্বাচন নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। যাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে তারাই বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচন কেবল শিক্ষার্থীদের ব্যাপার। এটা নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই।

গতকাল শুক্রবার ডাকসু নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ভিপি, জিএম প্রার্থীসহ অন্যান্য প্রার্থীরা জুম্মার নামাজের পর নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন। প্রত্যেকেই পায়জামা পাঞ্জাবী পড়ে জুম্মার নামাজ পড়তে যান। নামাজ পড়ে বের হয়েই যাকেই পেয়েছেন তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে ভোট চেয়েছেন। বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থী ভোটারদের কাছে নিজেদের কর্মপন্থা তুলে ধরেন তারা।

ছাত্রদল সমর্থিত সহ-সভাপতি (ভিপি) প্রার্থী আবিদুল ইসলাম ডাকসু নির্বাচনে ‘অভূতপূর্ব সাড়া’ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের সামনে সাংবাদিকদের ছাত্রদলের এই ভিপি প্রার্থী বলেন, আমরা যখন প্রচারে যাচ্ছি, অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। এতদিন পরে এসে মনে হচ্ছে, আসলেই সঠিক ছাত্ররাজনীতির চর্চাটা করছি। শ্রদ্ধা, স্নেহ, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও জবাবদিহির আওতায় ছাত্ররাজনীতি করছি। একটি গোষ্ঠী ছাত্রদলের প্যানেলের বিরুদ্ধে সাইবার বুলিং করছে, এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে একটি গোষ্ঠী অপপ্রচারে নেমেছে ও সাইবার বুলিং করছে। নির্বাচন কমিশনকে আমরা জানিয়েছি, যদি আপনারা এই সাইটগুলো বন্ধ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে গোটা জাতিকে আপনারা সেটি জানান যে আসলে সেটি আপনারা পারছেন না।

বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর মাস্টার দা সূর্যসেন হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এ সময় তিনি বলেন, ৫ আগস্টের আগে ভিন্নমত ধারণ করার কারণে অফলাইনে মারধর করা হতো। সরাসরি আক্রমণ করা হতো। গায়ে হাত তোলা হতো। কিন্তু এখন অনলাইনে বুলিং হচ্ছে। গায়ে হাত তোলার চেয়ে অনলাইনে নোংরা ভাষার ব্যবহার গালিগালাজ আরো বিপর্যস্ত করে দেয়। কেবল আমার ক্ষেত্রেই এমন হচ্ছে না। ভিন্নমত ধারণ করেন, এমন সবার ক্ষেত্রেই এমন হচ্ছে। একটা সময় গিয়ে মনে হয়েছে, একটু বোধহয় ভেঙে পড়েছি।ছাত্রশিবির সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী ঐক্যজোট প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজ আদায়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার দা সূর্যসেন হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সময় বলেন, আমাদের ৩৯ হাজার ভোটার আছে। কিন্তু আমাদের মাত্র আটটা সেন্টার। এবার সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোটাররা ভোট দিতে আসবেন। কিন্তু যে পরিমাণ ভোটকেন্দ্র, সেখানে কতটুকু ভোটকাজ সম্পন্ন হবে, সেটা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। আমাদের প্রার্থী সাবিকুন্নাহার তামান্নার ছবি বিকৃত করা হয়েছিল। আমরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ধরনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। আমাদের অন্যান্য নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও ক্রমাগত সøাট-শেমিং ও সাইবার বুলিং হচ্ছে।
‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল থেকে ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। তার প্রচার-প্রচারণায় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ছাত্রীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলার অঙ্গীকার। ছাত্রীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিতে তিনি একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে উমামা ফাতেমা নারীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়তে কী কী করবেন, তা ভোটারদের জানিয়েছেন।