Image description
 

আওয়ামী লীগ সরকার বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা পুনর্বহাল করে বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। 

 

তিনি আরও বলেছেন, গত বছরের ১৪ জুলাই তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ অভিহিত করে আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণের বৈধতা দেন। 

 

জুলাই- আগষ্টে সংঘটিত ব্যাপক হত্যাকান্ড, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন তিনি। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত দুই বিচারকের ট্রাইব্যুনালে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। নাহিদ ইসলাম এ মামলার ৪৭ তম সাক্ষী। 

 

বুধবার বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে ট্রাইব্যুনালে আসেন নাহিদ। ২টা ৫৪ মিনিটে তিনি জবানবন্দি শুরু করেন। বিকাল ৪টা ২০ মিনিট পর্যন্ত তার জবানবন্দি গ্রহণ করে আদালত। সোয়া এক ঘন্টার বেশি জবানবন্দিতে তিনি গণঅভ্যূত্থানের প্রেক্ষাপট, ধারাবাহিক আন্দোলন এবং গত বছরের ১৯ জুলাই পর্যন্ত নানা ঘটনা তুলে ধরেন। তার অসমাপ্ত জবানবন্দি শেষে আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাক্ষ্য গ্রহণ মুলতুবি করা হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নম্বর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালে তিনি প্রথম কোটা আন্দোলনে যুক্ত হন। কোটা সংস্কারের জন্য একটি বড় ছাত্র আন্দোল গড়ে উঠেছিল। ওই বছরের ৮ এপ্রিল এই আন্দোলন দমনের জন্য পুলিশ ও ছাত্রলীগ শাহবাগ এলাকায় আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করে। পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। রাতে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে গিয়ে আক্রমন করে। এ হামলার প্রেক্ষিতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। 

আন্দোলনের এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, ‘যদিও আমরা চেয়েছিলাম কোটার সংস্কার। তবে, সরকার (আওয়ামী লীগ সরকার) কোটা পদ্ধতি সম্পুর্ণ বাতিল করে। তবুও আমরা এটিকে আপাতত মিমাংসা হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘এই ঘোষণা সত্ত্বেও আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার শুরু করে পুলিশ। ছাত্রলীগ হামলা করে। পরবর্তীতে সরকার কোটা বাতিল করে গেজেট প্রকাশ করে।’ 

নাহিদ ইসলাম বলেন, সরকারের আচরণে আমরা বুঝতে পারি, আন্দোলন দমনের জন্য সরকার কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সরকার কোটা বাতিল চায়নি। কিছুদিন পর শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন যে, তিনি (শেখ হাসিনা) রাগের বশবর্তী হয়ে কোটা বাতিলের কথা বলেছিলেন। 
 
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে আশঙ্কা করেছিলাম যে, কোটা প্রথা আবার ফিরে আসবে। ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়। আমি সে নির্বাচনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্যানেল থেকে কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করি। নির্বাচনে অনিয়মের মাধ্যমে বেশিরভাগ পদে ছাত্রলীগকে জিতিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আমরা ছাত্রলীগের গেষ্ট রুম, গণরুম, নির্যাতন কালচারসহ অন্যান্য অনিয়ম আচরণের বিরুদ্ধে প্রদিবাদমুখর হই।’  

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট সরকারের কোটা বাতিল সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বাতিলপূর্বক কোটা প্রথা পুনর্বহাল করে। ওই তারিখে আমরা রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করি। পরবর্তীতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও বিক্ষোভ হয়। সরকারকে ৩০ জুনের মধ্যে কোটা সংস্কার সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে আলটিমেটাম দিয়েছিলাম। তাতে সাড়া না দেওয়ায় ১ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ২০১৮ সালে জারিকৃত পরিপত্র (কোটা বাতিলের) পুনর্বহালপূর্বক কোটা প্রথার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু করি এবং তা অব্যাহত থাকে।’  

নাহিদ ইসলাম বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন বিধায় সরকারের কিছু করার নেই। কোনো বক্তব্য থাকলে তা আদালতে গিয়ে বলতে হবে। তখন আমরা জানতাম বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করা হয়েছে এবং বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে সরকার পরিকল্পিতভাবে কোটা প্রথা পুনর্বহাল করেছে। সে কারণে আদালতে না গিয়ে রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখি। আন্তোলন তীব্রতর করতে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে ৭ জুলাই সারাদেশে কর্মসূচী ঘোষণা করি। সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আমাদের কর্মসূচীর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আন্দোলনে অংশ নেয়।” 

তিনি বলেন, ১০ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত না করে স্থিতাবস্থা দেয়। এতে আমরা হতাশ হই এবং আমরা নিশ্চিত হই যে, বিচার বিভাগ থেকে এ বিষয়ে কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না। আন্দোলনের এ পর্যায়ে আমরা বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হই। নাহিদ ইসলাম বলেন, “১৪ জুলাই রাতে শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ অবিহিত করে কোটা প্রথার পক্ষে অবস্থান নেন। তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমনের একটি বৈধতা দেওয়া হয়। কারণ আমরা দেখেছি, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ন্যায্য আন্দোলন করা হলে তাদেরকে ‘রাজাকার’ অ্যাখ্যা দিয়ে আন্দোলনের ন্যায্যতা নস্যাৎ করা হতো।”  

নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘ছাত্রদেরকে রাজাকারের বাচ্চা এবং রাজাকারের নাতিপুতি অ্যাখ্যায়িত করায় সারাদেশের ছাত্রছাত্রীরা অপমানিতবোধ করে। সেই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদমুখর হয়ে রাস্তায় নেমে আসে।’ 

তিনি বলেন, ১৫ জুলাই তারা বিক্ষোভ কর্মসচীর ডাক দেন। অন্যদিকে ছাত্রলীগ পাল্টা কর্মসূচী ঘোষণা করে। ওই দিনই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন যে ‘আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ঠ।’ তার এই ঘোষণায় উজ্জীবীত হয়ে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমন করে ব্যাপক নির্যাতন চালায়। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্রছাত্রীদের ওপরও হামলা করে। চিকিৎসাকাজে বাধা সৃস্টি করে। 

নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘এই হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচীর ডাক দেই। এই তারিখে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। চট্টগ্রামে ওয়াসিমসহ বিভিন্ন স্থানে ৬ জন শহীদ হন। তিনি বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে  ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচীতে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। 

বিশ্ববিদ্যালয়  প্রশাসন ও পুলিশ আমাদেরকে হলত্যাগের নির্দেশ দেয়। সেদিন ডিজিএফআই আমাদেরকে কর্মসূচী প্রত্যাহার করার এবং সরকারের সঙ্গে সংলাপের জন্য চাপ দেয়। এমনকি হলের বিদ্যুৎ, পানি ও খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমরা সরকারের সঙ্গে সংলাপে অসীকৃতি জানাই। ১৭ জুলাই রাতে দেশব্যাপি ‘কমপ্লিট শাটডাউন’র ঘোষণা দেওয়া হয়।’ 
 
তিনি বলেন, ‘আমাদের ভাই বোনদের হত্যা করা হয়েছে বিধায় আমরা সারাদেশের সকল শিক্ষার্থী ও জনগনকে কর্মসূচীতে অংশ নিতে আহবান জাাই। আমাদের ঘোষণার প্রেক্ষিতে ১৮ জুলাই ছাত্র- জনতা রাস্তায় নেমে আসে। সেদিন সারাদেশে অনেক ছাত্র- জনতা হতাহত হন। সেদিন রাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯ জুলাই পুলিশ এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আন্দোলনরত ছাত্র- জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে অনেক ছাত্র- জনতা হতাহত হন। ১৯ জুলাই আমরা বুঝতে পারি যে, সরকার ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সম্পুর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে। আমাদের আন্দোলনে আহত ও নিহতদের কোনো খবর কোনো মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছিল না।’