Image description

বিগত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে কাজ না করেই পিরোজপুর-২ (ভান্ডারিয়া-কাউখালী-নেছারাবাদ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দীন মহারাজ সরকারি এক হাজার ৭৯ কোটি টাকা তার পকেটে ভরেছেন।

ঠিকাদারি কাজে মহারাজ তার নিজ মালিকানাধীন মেসার্স হরিনপালা ট্রেডার্স ও মেসার্স তেলিখালি এন্টারপ্রাইজ এবং তার ভাই মিরাজুলের ইফতি ইটিসিএল প্রাইভেট লিমিটেড ও সালাউদ্দিনের মেসার্স ইশান এন্টারপ্রাইজ লাইসেন্স ব্যবহার করতেন।

এ কাজে সহায়তার অভিযোগ রয়েছে এলজিইডির প্রকল্প পরিচালক, জেলা এলজিইডি অফিস ও হিসাবরক্ষণ অফিসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

 

মহিউদ্দীন মহারাজের বিরুদ্ধে প্রকল্পের কাজ না করে এক হাজার ৭৯ কোটি ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৮৩৯ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পৃথক আটটি মামলা হয়েছে। মামলায় মেসার্স হরিনপালা ট্রেডার্সের মালিক মহিউদ্দীন মহারাজ, পিরোজপুর এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আলি আখতার হোসেন, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আব্দুর রশীদ খান, সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার হাওলাদারসহ ২৭ জনকে আসামি করা হয়।

এর মধ্যে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন- জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের জেলা অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসার মোহাসীন, এসএএস সুপার মাসুম হাওলাদার, নজরুল ইসলাম, সাবেক ডিস্ট্রিক্ট অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসার আলমগীর হাসান ও পিরোজপুর এলজিইডি অফিসের হিসাবরক্ষক এ কে এম মোজাম্মেল হক খান। অপর আসামিদেরও গ্রেফতারে অভিযান চলছে বলে জানিয়েছেন পিরোজপুর জেলা দুদক কার্যালয় সূত্র।

 

ঠিকাদারি কাজ না করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে মহারাজের ভাই মিরাজুল ও সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধেও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভান্ডারিয়ার নদমুল্লা ইউনিয়নের নদমুল্লা মাদ্রাসাহাট চিংগুড়িয়াকলোনি বাজার সড়কের মোল্লাবাড়ির সামনে আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ না করে সাড়ে তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ব্রিজটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল মিরাজুলের ইফতি ইটিসিএল প্রাইভেট লিমিটেড।

মহারাজ ছিলেন পিরোজপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। মিরাজুল ভান্ডারিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ভান্ডারিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ভান্ডারিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন মহারাজের আরেক ভাই সালাউদ্দিন। বর্তমানে তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে দৌড়ঝাঁপ করছেন।

চিংগুড়িয়াকলোনি বাজার এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলামসহ একাধিক গ্রামবাসী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আয়রন ব্রিজ হচ্ছে- এমন সংবাদে গ্রামবাসী হিসেবে খুশি হয়েছিলাম। আমাদের অপেক্ষা ছিল কবে ব্রিজের কাজ শুরু হবে। কিন্তু ব্রিজের কাজ শুরু না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট দফতরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, কাগজে-কলমে ব্রিজের কাজ শেষ হয়েছে। টাকাও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উত্তোলন করে নিয়েছে। কিন্তু যারা এর ঠিকাদার সাবেক এমপি মহারাজ ও মিরাজুল তাদের বিরুদ্ধে কোনও কথা বলার সাহস ছিল না আমাদের। এ কারণে গ্রামবাসী নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে সাঁকো দিয়ে পারাপার মেনে নিয়েছেন।’

তারা আরও বলেন, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্রিজের কাজ পরিদর্শনে সরকারি কর্মকর্তারা এসেছিলেন। তারা গ্রামবাসীর সাক্ষাতকারও নিয়েছেন। তারা দেখে গেছেন, প্রায় চার কোটি টাকার ব্রিজে হচ্ছে বাঁশের সাঁকো। এ ছাড়া নদমুল্লায় আরও একটি ব্রিজ হওয়ার কথা ছিল- সেটি পরিদর্শনে গিয়েও কোনও ব্রিজ পাননি তারা। গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে ব্রিজ নির্মাণে তাদের কাছে অনুরোধ জানানো হয়। তারা আশ্বাস দিয়েছেন, সেখানে ব্রিজ নির্মাণের। একইসঙ্গে গ্রামবাসী মহারাজ ও মিরাজুলের বিচার দাবি করেন।

এলজিইডি সূত্র থেকে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আয়রন ব্রিজ পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় এই সেতুর জন্য ৩ কোটি ৭১ লাখ টাকার চুক্তি হয়। এলজিইডি ৯৫ শতাংশ অগ্রগতি দেখিয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা পরিশোধ করে। অথচ সেতুটি আজও নির্মিত হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। কাজটি দেওয়া হয়েছিল মহারাজের ভাই মিরাজুলের ইফতি ইটিসিএল প্রাইভেট লিমিটেডের লাইসেন্সে।

একই সড়কে আরও একটি ৩০ মিটার দীর্ঘ সেতুর হওয়ার কথা থাকলেও কোনও হদিস নেই। এর কাজ পায় মহিউদ্দিন মহারাজের আরেক ভাই সালাউদ্দিনের প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইশান এন্টারপ্রাইজ। এটিও ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল।

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সরেজমিনে গিয়ে শুধু এই দুটি নয়, কাগজে-কলমে আরও দুটি ব্রিজও খুঁজে পায়নি। সেগুলো হলো চরখালি-মঠবাড়িয়া সড়কের বিনাপানি বাজার-চৌহুরিয়া বাজার এলাকায় ১৫ মিটার দীর্ঘ ব্রিজ এবং মালিয়ারহাট নতুন নলবুনিয়া সড়কের ২৫ মিটার দীর্ঘ আরসিসি ব্রিজ।

প্রকল্পের কাগজে ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ অগ্রগতি দেখানো হয়েছে এবং বিলও দেওয়া হয়েছে। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেবল আয়রন ব্রিজ প্রকল্পেই কোনও কাজ না করেই ১২১ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। শুধু একটি প্রকল্প নয়, বরিশাল বিভাগের সড়ক প্রশস্তকরণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্প এবং পিরোজপুরের পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পেও একই চিত্র। তিন প্রকল্পের ১৩৭টি প্যাকেজে কোনও কাজ হয়নি অথচ ৩৪৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। টাকা নিয়েছে ওই মহারাজের পরিবারের তিন প্রতিষ্ঠান।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় এলজিইডির কর্মকর্তারা তাদেরকে জানিয়েছেন সাবেক এমপি মহারাজের সরাসরি হস্তক্ষেপে এসব অনিয়ম হয়েছে। তার পরিবার ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতো এবং কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কোনও কাজ ছাড়াই টাকা তোলা হতো। এলজিইডির সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার এবং হিসাবরক্ষক মোজাম্মেল হক খানকেও এই অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্প পরিচালকরা মাঠপর্যায়ে অগ্রগতি যাচাই না করেই বিল অনুমোদন দিয়েছেন। ফলে তারাও দায়ী। এমনকি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই অফলাইনে দরপত্র আহ্বানের মতো অনিয়মও ধরা পড়েছে। শুধু পিরোজপুরেই ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আয়রন ব্রিজ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৯২৩ দশমিক ৪৯ কোটি টাকা। একটি জেলার জন্য এত বরাদ্দ অস্বাভাবিক, এর দায়ও এলজিইডির শীর্ষ কর্তাদের ওপর বর্তায়।

এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, এ ধরনের অপরাধে সংঘটিত হয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে দুদকের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়েছে।