বিওয়াইএলসির যুব জরিপ থেকে দেখা গেছে, বিএনপি ও জামায়াত শীর্ষস্থান দখলের জন্য লড়ছে। কিন্তু এই দুই দলের কেউই নিরঙ্কুশ সমর্থন তৈরি করতে পারছে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের টিকে থাকা সমর্থক, সেই সঙ্গে সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের বড় সংখ্যা থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো পরিবর্তনশীল। বিএলওয়াইসির যুব জরিপ বিশ্লেষণ করেছেন ডেভিড বার্গম্যান
বাংলাদেশে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠী মোট ভোটারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এই তরুণদের ওপর চালানো একটি নতুন জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। জরিপটি চালিয়েছে বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি)। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি ইংরেজি, বাংলা ও মাদ্রাসা—তিন ধরনের শিক্ষা ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
গত ১০ থেকে ২৫ অক্টোবরের মধ্যে চালানো জরিপে ২,৫৪৫ জন অংশ নেন। দেশের ভৌগোলিক ও জনমিতিক বৈচিত্র্য প্রতিফলিত করার জন্য ‘র্যান্ডম স্যাম্পলিং’ পদ্ধতিতে তাঁদের নির্বাচন করা হয়।
বাংলাদেশে জরিপকে মানুষ সাধারণত সন্দেহের চোখে দেখে। এমনকি সেগুলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করা হলেও লোকের সন্দেহ যায় না।
অনেকের যুক্তি হলো, মাত্র হাজার কয়েক লোকের উত্তর দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের জটিলতাকে পুরোপুরি তুলে ধরা সম্ভব নয়। এ ছাড়া নাগরিকেরা অপরিচিত মানুষের কাছে তাদের আসল রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ করতে চায় না।
সাধারণভাবে জরিপের ফল নিয়ে কিছুটা সন্দেহ থাকাটা ঠিক আছে। কারণ, জরিপ সব সময় শতভাগ নির্ভুল হয় না। কিন্তু যদি আপনি জরিপকে একেবারে গুরুত্বই না দেন, তাহলে সেখানে যে গুরুত্বপূর্ণ সংকেত বা তথ্য পাওয়া যেতে পারে সেগুলো দেখাই হবে না।
বিশেষ করে গত সরকার পতনের পর যেসব জরিপ হয়েছে, সেগুলো একটার পর একটা প্রায় একই রকম ফল দেখাচ্ছে। তাই সব জরিপকে অগ্রাহ্য করলে এই ধারাবাহিক তথ্যগুলো বোঝার সুযোগও হারিয়ে যেতে পারে।
বিওয়াইএলসির যুব জরিপের ছয়টি মূল বিষয় এখানে তুলে ধরছি:
১. যুবকদের মধ্যে ভোট দেওয়ার প্রবল আগ্রহ
জরিপের একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো—যুবসমাজের মধ্যে ভোট দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের মধ্যে ৯০ শতাংশই জানিয়েছেন, তাঁরা নিবন্ধিত ভোটার।
আর তাঁদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে চান। এটি দেখায়, বাংলাদেশের তরুণেরা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এখনো অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকতে চান।
২. বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী প্রায় সমান অবস্থানে
জরিপের ফল দেখাচ্ছে, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী খুব কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। বিএনপি সামান্য ৩ পয়েন্টে এগিয়ে (বিএনপি ২০ শতাংশ, জামায়াত ১৭ শতাংশ) রয়েছে।
তবে জরিপে সব সময় কিছুটা ভুলের আশঙ্কা থাকে, যাকে ‘মার্জিন অব এরর’ বলা হয়। এখানে বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থনের মধ্যে যে ৩ শতাংশের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে, সেই পার্থক্য খুব ছোট।
‘মার্জিন অব এরর’ বা সম্ভাব্য ভুলের সীমা হিসাব করলে এই ছোট পার্থক্যটি আসলে মুছেও যেতে পারে। জরিপে বিএনপিকে এগিয়ে থাকতে দেখা গেলেও প্রকৃত চিত্রে তারা সমান অবস্থানে থাকতে পারে।
আঞ্চলিক চিত্র অবশ্য একটু ভিন্ন। চট্টগ্রাম (১৯ শতাংশ বনাম ১০ শতাংশ), ঢাকা (২৪ শতাংশ বনাম ১৯ শতাংশ) ও রাজশাহীতে (৩৯ শতাংশ বনাম ২৭ শতাংশ) বিএনপি শক্তিশালী অবস্থানে আছে। অন্যদিকে খুলনায় জামায়াত বেশ এগিয়ে আছে (২৯ শতাংশ বনাম ১৩ শতাংশ)।
স্বাভাবিকভাবেই উল্লেখ করা জরুরি যে ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ ব্যবস্থায় (‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ ব্যবস্থা হলো এমন ভোট ব্যবস্থা, যেখানে একজন প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পেলে সোজাসুজি জয়ী হয়। সেখানে অর্ধেকের বেশি ভোট পাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই) শুধু মোট শতাংশ দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ভুল হতে পারে; কারণ একটি দল কতটা ভালো করবে, তা অনেকটাই তাদের ভোট কতটা ‘কার্যকরভাবে’ বিভিন্ন আসনে ছড়িয়ে আছে তার ওপর নির্ভর করে।
হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর উত্থান একটি বড় পরিবর্তন হিসেবে সামনে এসেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সমর্থন করা এবং যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার কারণে যে সামাজিক বদনাম তাদের ছিল ছিল, তা অনেকটাই কমে গেছে বলে মনে হচ্ছে। নিজেদের ‘মধ্যপন্থী’ ধর্মীয় দল হিসেবে পুনর্গঠনের প্রচেষ্টাও কিছুটা সফল হয়েছে। তবে মাত্র ১৭ শতাংশ সমর্থন তাদের ব্যাপক জনসমর্থন অর্জন থেকে এখনো অনেক দূরে রেখেছে।
অন্যদিকে বিএনপির জন্য ২০ শতাংশ সমর্থন হতাশাজনক। অনেকে ধারণা করেছিলেন, আওয়ামী লীগের পতনে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হবে বিএনপি। দলটি ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় ভোটের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করে বলে মনে করা হয় এবং অনেক বিশ্লেষক মনে করতেন, আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির সমর্থনও বেড়ে গেছে।
কিন্তু এই জরিপের ফলাফল দেখাচ্ছে—আওয়ামী লীগ প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে না থাকায় বিএনপির সমর্থনও কমে এসেছে।
৩. আওয়ামী লীগ এখনো উল্লেখযোগ্য সমর্থন ধরে রেখেছে
কিছুটা অবাক করার মতো বিষয় হলেও জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ১০ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে চান। বছরের পর বছর ধরে দলের স্বৈরাচারী আচরণ এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সহিংসতা ঘটাবার পরও তারা এই জরিপে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন আওয়ামী লীগকে নিয়ে চারদিকে সমালোচনা, সামাজিকভাবে নিন্দা এবং তাদের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া আইনত অপরাধ নির্ধারিত হয়েছে, তখনো এই ১০ শতাংশ সমর্থনে দেখা যাচ্ছে যে দলের মৌলিক সমর্থকগোষ্ঠী এখনো টিকে আছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের মূল ‘সমর্থক–ঘাঁটি’ পুরোপুরি ভেঙে যায়নি; বরং অনেকটা স্থায়ীভাবেই টিকে আছে।
উল্লেখ্য, এই জরিপ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবার আগে।
৪. ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টির (এনসিপি) হতাশাজনক সূচনা
২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের একাংশের গড়ে তোলা ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি (এনসিপি) জরিপে মাত্র ৪ শতাংশ সমর্থন পেয়েছে।
তরুণেরাই যেহেতু এনসিপির প্রধান লক্ষ্যভিত্তিক সমর্থক, তাই এই কম জনসমর্থন দেখাচ্ছে—দলটির সাংগঠনিক অবস্থা খুব দুর্বল এবং ভোটের মাঠে তাদের প্রভাব সীমিত। কৌশলগত জোট না করলে সংসদে একটি আসন পাওয়াও তাদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে যাবে।
৫. সিদ্ধান্তহীন ও নীরব ভোটাররা
জরিপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলগুলোর একটি হলো, বহুসংখ্যক তরুণ এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি কাকে তারা ভোট দেবে। প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, তাঁরা এখনো কোনো দলকে বেছে নেননি। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে এলে এই বড় অংশের ভোট বিভিন্ন দিকে সরে যেতে পারে।
আরও ১৮ শতাংশ তরুণ তাঁদের পছন্দ জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এই গ্রুপের মধ্যে এমন বহু ‘নীরব’ আওয়ামী লীগ সমর্থক থাকতে পারেন, যাঁরা প্রকাশ্যে নিজেদের মত বলেন না। যদি ধরে নেওয়া হয়, এই ১৮ শতাংশের অর্ধেক, মানে ৯ শতাংশ ভোটার আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে, তাহলে আগে জরিপে যে ১০ শতাংশ আওয়ামী লীগের সমর্থন দেখা গেছে, তার সঙ্গে আরও ৯ শতাংশ যোগ হতে পারে।
এতে আওয়ামী লীগের প্রকৃত সমর্থন দাঁড়াতে পারে প্রায় ১৯ শতাংশের মতো। এটি বিএনপি (২০ শতাংশ) বা জামায়াতের (১৭ শতাংশ) সমর্থনের কাছাকাছি বা কিছু ক্ষেত্রে সমান বা বেশিও হতে পারে।
তবে বিএনপি ও জামায়াত—এই দুই দলের মোট সমর্থনের (২০ শতাংশ + ১৭ শতাংশ = ৩৭ শতাংশ) চেয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থন তখনো কম থাকবে।
৬. সাবেক আওয়ামী লীগ ভোটারদের ভবিষ্যৎ
ধরা যাক, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তাহলে তাদের সাবেক সমর্থকেরা কোথায় ভোট দিতে পারেন, সে বিষয়ে জরিপ কিছু ইঙ্গিত দেয়। জরিপে দেখা গেছে, এঁদের অর্ধেকের বেশি (৫৬ শতাংশ) বলেছেন, তাঁরা ভোট দেবেন না। আর যাঁরা ভোট দেবেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে সমর্থন সরিয়ে নিচ্ছেন বিএনপি (২০ শতাংশ) বা জামায়াতের (১৭ শতাংশ) দিকে। তবে এখনো ৪১ শতাংশ সাবেক আওয়ামী লীগ ভোটার সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় আছেন।
অনেক বিশ্লেষককে এটি অবাক করেছে যে কিছু সাবেক আওয়ামী লীগ সমর্থক ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামীকে এখন সমর্থন করতে ইচ্ছুক।
এই পরিবর্তনের দুটি প্রধান কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো, স্থানীয় বিএনপির কর্মীরা যেহেতু সাবেক আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছেন বলে জানা গেছে, সেহেতু সাবেক আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অনেকেই জামায়াতকে ‘কম খারাপ’ বিকল্প হিসেবে দেখছেন।
দ্বিতীয় কারণ হলো, রাজনৈতিক যুক্তি। যুক্তিটি হলো, আওয়ামী লীগের একটি অংশ মনে করতে পারে, যদি জামায়াত ক্ষমতায় আসে, তাহলে প্রমাণ হবে, আওয়ামী লীগের দাবিটিই সঠিক ছিল; অর্থাৎ তখন প্রমাণ হবে বাংলাদেশকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগই একমাত্র প্রকৃত প্রতিবন্ধক ছিল।
শেষ কথা
বিওয়াইএলসির যুব জরিপ দেখাচ্ছে, বিএনপি ও জামায়াত শীর্ষস্থান দখলের জন্য লড়ছে; কিন্তু এই দুই দলের কেউই নিরঙ্কুশ সমর্থন তৈরি করতে পারছে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের টিকে থাকা সমর্থক, সেই সঙ্গে সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের বড় সংখ্যা থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো পরিবর্তনশীল।
-
ডেভিড বার্গম্যান দীর্ঘদিন বাংলাদেশ বিষয়ে লেখালেখি করছেন। তাঁর সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করা যাবে এখানে: david.bergman.77377
*মতামত লেখকের নিজস্ব