ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় বিতর্কিত প্রার্থীদের সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। বিভিন্ন আসনে কোন্দল নিরসনের তাগিদ দেয়া হয়েছে দলের দায়িত্বশীল নেতাদের। একই সঙ্গে নির্বাচনের পূর্ণ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নির্বাচনী ইশতেহার চূড়ান্ত করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জনগণের রায়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে দল আগামী দিনে কী কী বাস্তবায়ন করতে চায়, কী কী পরিবর্তন আনবে এবং দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একাধিক লিফলেটের মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরবে। নির্বাচনী তফসিলের পর আনুষ্ঠানিকভাবে ইশতেহার ঘোষণা করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। গত সোমবার রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপি’র সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বৈঠক সূত্র জানায়, গত ৩রা নভেম্বর ২৩৭ আসনে দলের প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণা করার পর থেকে অর্ধ শতাধিক আসনে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। এই বিষয়টি নিয়ে পুরো দল বিব্রত। এ রকম পরিস্থিতিতে যেসব আসনে বিতর্কিত কিংবা বয়োবৃদ্ধ অথবা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে কোন্দলের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করেছে, সেসব আসনে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করেন নেতারা। আগামী নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করে বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বলেন, বিতর্কিতদের সরিয়ে ত্যাগী আর যোগ্যদের মূল্যায়ন করা হলে অনেক ক্ষেত্রে কোন্দল নিরসন হবে। সেখানে স্থায়ী কমিটির একজন নেতা চট্টগ্রাম-১২ আসনের কথা তুলে ধরে বলেন- এই আসনে এমন একজনকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে, যার বিরুদ্ধে মূলধারার সংবাদমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক নেতিবাচক তথ্য প্রচার হচ্ছে। যা দলের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আবার অনেক আসনে বয়োবৃদ্ধ নেতাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। যারা চলাফেরা করতেও অন্যের সহায়তা নেন। এমন আসনেও মনোনয়ন পরিবর্তনের কথা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে একজন নেতা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪, কুষ্টিয়া-৪ ও জামালপুর-২ আসনের তথ্য তুলে ধরেন। কিছু আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তীব্র কোন্দলের মাত্রা এতো বেশি যে সেখানে যাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে তবুও কোন্দল থাকতে পারে। এমন আসন চিহ্নিত করে সব নেতাকে ঢাকায় ডেকে সমাধানের জন্যও বলা হয়েছে।
ওদিকে নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে প্রচারণায় নামার প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে দলটি আগামী দিনে কী কী বাস্তবায়ন করতে চায়, কী কী পরিবর্তন আনবে, দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একাধিক লিফলেটের মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরবে বিএনপি। আগামীতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে দেশ পুনর্গঠনে প্রতিটি সেক্টরে কর্মপরিকল্পনা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরবে। মোটাদাগে লিফলেটে দেশের উন্নয়নে বিএনপি’র কর্মপরিকল্পনা, নাগরিকদের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেবে, রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফাসহ নানা প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হচ্ছে। যেমন শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য খাত, কৃষি ও খাদ্য, শিল্প খাত, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রীড়া, প্রশাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ প্রতিটি সেক্টরকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তুলে ধরে আলাদা লিফলেটের মাধ্যমে প্রচার করবে বিএনপি। উন্নয়নে কী কী পদক্ষেপ নেবেন, সেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তারা। এর মধ্যদিয়েই কেন্দ্রীয়ভাবে প্রচার ও গণসংযোগে নামার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপি হাইকমান্ডের। এ ছাড়া প্রতিটি এলাকায় সুবিধা-অসুবিধা আর জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দেয়া হবে লিফলেটে। তরুণ প্রজন্ম ও নারী ভোটার দৃষ্টি আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য লিফলেটে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হবে। এসব লিফলেটে দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্যও নেতাকর্মীদের প্রতি বিশেষ নির্দেশ থাকবে।
নির্বাচনী ইশতেহার: নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহার চূড়ান্ত করার কাজে হাত দিয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, এবারের ইশতেহার গঠিত হবে বিএনপি’র ঘোষিত ৩১ দফা, জুলাই সনদ এবং সামপ্রতিক রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার সমন্বয়ে। নির্বাচনী শাসনব্যবস্থা পুনর্গঠন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, মানবাধিকার রক্ষা ও দুর্নীতিবিরোধী কাঠামো শক্তিশালীকরণ ইশতেহারের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, জনগণকে রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরিয়ে দেয়া এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলাই হবে বিএনপি’র অঙ্গীকার। নির্বাচনের ইশতেহার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ইশতেহারে এবং নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় কী কী বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে তা নিয়ে নেতারা মতামত দিয়েছেন।
৩১ দফা ও জুলাই সনদের প্রতিফলন: ইশতেহারে বিএনপি’র ৩১ দফার মূল বিষয়- অবাধ নির্বাচন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোট, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, মানবাধিকার সুরক্ষা, বাকস্বাধীনতা, স্বচ্ছ প্রশাসন এবং জাতীয় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার-বিশদভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ ছাড়া জুলাই সনদের আলোকে নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা দেয়ার পরিকল্পনাও ইশতেহারে গুরুত্ব পাবে।
শ্রেণিভিত্তিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রচারণায় নামবে বিএনপি: দলীয় কৌশল অনুযায়ী এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশাকে আলাদাভাবে টার্গেট করবে। এ তালিকায় রয়েছে- আলেম-ওলামা, হিন্দু ও সংখ্যালঘু সমপ্রদায়, যুবক, কৃষক, নারী এবং বৃদ্ধরা। দলটির ইশতেহারে কওমি মাদ্রাসা উন্নয়ন, ইসলামিক গবেষণা তহবিল গঠন, ধর্মীয় শিক্ষার আধুনিকায়ন ও ধর্মচর্চার বাধাহীন পরিবেশ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার থাকবে। এ ছাড়া ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল রোধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, নিরাপত্তা সেল, উৎসবে রাষ্ট্রীয় সহায়তা এবং সামপ্রদায়িক হামলা প্রতিরোধে কঠোর কার্যক্রম চালুর প্রতিশ্রুতি যুক্ত হবে।
যুবসমাজকে টার্গেট করে বিএনপি বড় পরিসরে কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি যুক্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে-১ কোটি নতুন চাকরি, স্টার্টআপ ফান্ড, আইটি প্রশিক্ষণ, বিদেশে নতুন শ্রমবাজার ও মাদকবিরোধী টাস্কফোর্স। তারেক রহমানের ভাষায়, নতুন বাংলাদেশ গড়বে যুবসমাজ, চাকরির সংকট নয়, দক্ষতার ভিত্তিতে বৈশ্বিক সুযোগ সৃষ্টি করবে বিএনপি।
কৃষককে গুরুত্ব দিয়ে ইশতেহার তৈরি করা হবে: কৃষি উপকরণের দাম কমানো, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত, কৃষিঋণ সহজ করা এবং ধান-চাল কেনার স্বচ্ছ ব্যবস্থা। তারেক রহমান সমপ্রতি বলেছেন, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ফসল বিক্রি করবে- এটা আর হবে না। এ ছাড়া নারী নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ, নারী উদ্যোক্তা তহবিল, মাতৃত্বকালীন ভাতা বৃদ্ধি এবং সহিংসতা প্রতিরোধে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল- এগুলোও ইশতেহারের অংশ হচ্ছে। ইশতেহারে ফ্যামিলি কার্ড, বৃদ্ধ ভাতা বৃদ্ধি, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা সমপ্রসারণ ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি শক্তিশালী করার অঙ্গীকারও যুক্ত হবে।
বৈঠক সূত্র জানায়, দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তফসিলের পর একটি বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইশতেহার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। নেতারা আশা করছেন, ৩১ দফা, জুলাই সনদ ও টার্গেট গ্রুপভিত্তিক প্রতিশ্রুতি-এ তিনের সমন্বিত ইশতেহার তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় নতুন গতি এনে দেবে। এ ছাড়া বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনা করেছেন স্থায়ী কমিটি সদস্যরা। তবে এই মূহূর্তে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়নি।