দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ সবসময়ই ভারতের নিকট প্রতিবেশী ও কৌশলগত অংশীদার হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কারণে দুই দেশের সম্পর্ককে বন্ধুত্ব বলা হতো। কিন্তু পঞ্চাশ বছর পর এসে সেই বন্ধন আজ রক্তাক্ত স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা শেখ হাসিনার একচেটিয়া শাসনকে এতটাই প্রশ্রয় দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের জনগণের চোখে ভারত এখন মিত্র নয়, একপ্রকার রাজনৈতিক আগ্রাসনের প্রতীক।
গত দেড় দশকে শেখ হাসিনা সরকার যেভাবে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করেছে, ভোটহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থেকেছে এবং বিরোধী মত দমন করেছে—তার পেছনে ভারতের প্রকাশ্য সমর্থন ও কূটনৈতিক আশীর্বাদ ছিল। দিল্লি সব সময় ঢাকায় স্থিতিশীলতা চেয়েছে, কিন্তু সেই স্থিতিশীলতা এসেছে গণতন্ত্রকে হত্যা করে। আর এই “স্থিতিশীলতা”র নামে ভারত বাস্তবে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলাফল হলো, ভারত এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপকারী শক্তি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
শেখ হাসিনার ‘স্থিতিশীলতা’ মানেই ভারতের নিরাপত্তা
ভারতের দৃষ্টিতে শেখ হাসিনা ছিলেন “নিরাপদ বন্ধু”। তিনি দিল্লির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন যে, বাংলাদেশ কখনোই ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে না, উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর জন্য আশ্রয়স্থল হবে না। এই নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিনিময়ে ভারত তাঁর সরকারকে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়েছে। এমনকি ভোটহীন নির্বাচন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সংবাদপত্র বন্ধ—কোনো কিছুতেই ভারতের আপত্তি ছিল না।
ভারতীয় মিডিয়া ও কূটনীতিকদের ভাষায়, “শেখ হাসিনা দিল্লির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু।” কিন্তু এই বন্ধুত্ব বাংলাদেশের জনগণের নয়—একটি দল ও তার নেতৃত্বের সঙ্গে ভারতের লেনদেনভিত্তিক সম্পর্ক। দিল্লি যতদিন এই বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ থাকবে, ততদিন বাংলাদেশের জনমনে ভারতের প্রতি ক্ষোভ শুধু বাড়বে।
সীমান্তে হত্যা, পানি-বণ্টন আর বাণিজ্য বৈষম্য
ভারতের কথিত “বন্ধুত্বপূর্ণ” নীতির বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় সীমান্তে প্রতিদিনের গুলিতে। বিএসএফের গুলিতে সাধারণ বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হন, অথচ দিল্লি ও ঢাকা—দু’পক্ষের সরকারই এ নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। শেখ হাসিনার সরকার নীরব থাকে, কারণ ভারতকে বিরক্ত করার সাহস তাঁর নেই।
একইভাবে, তিস্তা চুক্তি আজও কাগজে রয়ে গেছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি—বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তি—দেখিয়ে বছর বছর বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়ে সময় কাটাচ্ছে দিল্লি। কিন্তু বাস্তবে তারা পানি আটকে রেখেছে, কৃষি ও নদী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে।
বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ভারতের আচরণ আধিপত্যবাদী। বাংলাদেশ ভারতের জন্য একটি বিশাল বাজার, কিন্তু ভারত বাংলাদেশের পণ্যের জন্য দেয় না সমান সুযোগ। আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য সর্বদা ভারতের পক্ষে। ভারতীয় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে একচেটিয়া দখল তৈরি করেছে, অথচ বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা নানা ধরনের অজুহাতে বাধার সম্মুখীন। এই বৈষম্যমূলক সম্পর্ককে “বন্ধুত্ব” বলা যায় না—এটি নিছক শোষণ।
শেখ হাসিনাকে আঁকড়ে ধরা ভারতের কৌশল
২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪—এই তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে ভারত স্পষ্টভাবে শেখ হাসিনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাঁর স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে ভারত লবিং করেছে, পশ্চিমা সমালোচনা প্রশমিত করেছে। কিন্তু এখন স্পষ্ট হচ্ছে, এই নীতি ভারতের জন্যই উল্টো ফল বয়ে এনেছে। শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের জনমনে ভারতকে দেখা হচ্ছে একপ্রকার রাজনৈতিক অভিশাপ হিসেবে।
ভারত ভেবেছিল, হাসিনাকে আঁকড়ে ধরে রাখলেই বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। অথচ হাসিনার পতন প্রমাণ করেছে—ভারত ভুল পথে বাজি ধরেছিল। শেখ হাসিনার দল যখন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, তখন ভারতের আশীর্বাদও তার পতন ঠেকাতে পারেনি। আজ বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতের অবস্থান সন্দেহের জায়গায়। জনমনে প্রশ্ন—ভারত কি সত্যিই বাংলাদেশের বন্ধু, নাকি কৌশলগত স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করেছে?
বাংলাদেশের জনগণের চোখে ভারত
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন ভারতের প্রতি যে ক্ষোভ পোষণ করছে, তা কেবল রাজনীতি থেকে জন্ম নেয়নি। সামাজিক মাধ্যম, নাগরিক আলোচনায় আজ ভারতকে দেখা হচ্ছে এক ধরনের “গোপন শত্রু” হিসেবে—যে দেশ গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বলে, অথচ প্রতিবেশী দেশে একনায়কতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের নীতির বিরুদ্ধে ঢাকায় এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণদের প্রতিবাদ হয়েছে। “ভারতের হস্তক্ষেপ বন্ধ করো” স্লোগান এখন সাধারণ কথায় পরিণত হয়েছে। অতীতে যেমন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল, আজ সেই আবেগের অনেকটাই ভারতের দিকে ঘুরে গেছে।
মিত্র থেকে শত্রুতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া
একসময়ের মুক্তিযুদ্ধের মিত্র এখন বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা রাজনীতির সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ভারতের কূটনীতি আজ এমনভাবে প্রভাবিত করছে, যেন বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, বরং দক্ষিণ ব্লকের এক উপগ্রহ। ঢাকায় ভারতের প্রভাব বিস্তারের এই মানসিকতা বাংলাদেশের জাতীয় গর্বকে আঘাত করছে।
ভারত নিজের স্বার্থে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়—কোন দল ক্ষমতায় থাকবে, কে প্রধানমন্ত্রী হবে, কোন নীতি গৃহীত হবে—এসব বিষয়ে দিল্লির আগ্রহ অত্যধিক। কিন্তু এই অতিরিক্ত আগ্রহই ভারতকে এখন বাংলাদেশের জনগণের চোখে শত্রুতে পরিণত করেছে।
ভবিষ্যতের বাস্তবতা: বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক দিক
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক সংস্কার, নির্বাচন, এবং জনগণের অংশগ্রহণের পথে হাঁটছে। এই প্রক্রিয়ায় ভারতের ভূমিকা এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যদি তারা আবারও দলীয় পক্ষপাত দেখায়, তবে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সম্পর্ক চিরতরে হারাবে।
ভারতের উচিত এখন বোঝা, বাংলাদেশ কোনো “ছোট ভাই” নয়—বরং ১৭ কোটি মানুষের স্বাধীন রাষ্ট্র। সমতা, পারস্পরিক সম্মান ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তোলাই দুই দেশের ভবিষ্যতের একমাত্র পথ।
শেখ হাসিনাকে অন্ধভাবে প্রশ্রয় দিয়ে ভারত একটি ঐতিহাসিক ভুল করেছে। তারা বুঝতে পারেনি, কোনো দেশের জনগণকে পাশ কাটিয়ে কেবল একজন নেতাকে ধরে রাখলে সেই সম্পর্ক টিকবে না। আজ বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র চায়, স্বাধীনতা চায়, মর্যাদা চায়। সেই চাওয়ার পথে ভারতের আগ্রাসী কূটনীতি বাধা হয়ে দাঁড়ালে বাংলাদেশ আর তাকে মিত্র মনে করবে না।
ভারত যদি এখনো আত্মসমালোচনার পথে না যায়, যদি তারা শেখ হাসিনার ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের জনগণের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে—যেমন একদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমরা লড়েছিলাম, তেমনি ভবিষ্যতে ভারতের প্রভাব থেকেও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেবে।
বাংলাদেশ কখনোই কারও তাঁবেদার রাষ্ট্র নয়। যারা এই সত্যটি ভুলে যায়, তারা বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হয়—আর আজ ভারতের অবস্থান ঠিক সেই জায়গাতেই।
নতুন প্রেক্ষাপটে ভারতের অবস্থান পুনর্বিবেচনা
বাংলাদেশে এখন গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের সময়। দীর্ঘ একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসানে জনগণ তাদের রাষ্ট্র পুনর্গঠনের পথে হাঁটছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের মুহূর্তে ভারত যদি অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা না নেয়, তবে তাদের কূটনৈতিক অবস্থান আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আজকের তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতার কৃতিত্বের জন্য ভারতকে শ্রদ্ধা করে ঠিকই, কিন্তু তাদের চোখে ভারতের বর্তমান রূপ এক আধিপত্যবাদী প্রতিবেশীর।
ভারতের রাজনৈতিক মহল এখনো যেভাবে শেখ হাসিনার অতীত নীতিকে আঁকড়ে ধরে আছে, তাতে বোঝা যায় তারা বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ। দিল্লি যদি মনে করে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে “নিজস্ব লোক” স্থাপন করে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বজায় রাখা যাবে, তবে সেটা আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এমন এক মোড়ে, যেখানে জনগণের ইচ্ছা ছাড়া কোনো শক্তিই টিকে থাকতে পারবে না।
ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক তৈরি করা—দলীয় আনুগত্যের ওপর নির্ভর না করে জনগণের ম্যান্ডেটকে সম্মান করা। বাংলাদেশের মানুষ চায় না ভারতবিরোধী হতে, কিন্তু ভারত নিজের আচরণ দিয়ে সেই প্রতিক্রিয়াই তৈরি করছে। সীমান্তে গুলি, নদীর পানি আটকে রাখা, পণ্যবাণিজ্যে একচেটিয়া অবস্থান, আর ঢাকায় দলীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ—এই প্রতিটি বিষয়ে ভারতের কূটনৈতিক অহংকারই জনমতের আস্থা নষ্ট করছে।
নতুন ভারসাম্যের প্রয়োজন
আজকের দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন শক্তি ভারসাম্য গড়ে উঠছে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান—সবাই বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারত যদি এখনো পুরনো মানসিকতা থেকে বেরিয়ে না আসে, তবে এই অঞ্চলে তার প্রভাব ক্রমশ কমে যাবে। বাংলাদেশ যদি নতুন অংশীদারদের সঙ্গে সমতা ও পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে সম্পর্ক তৈরি করে, তবে ভারতের আধিপত্য ভেঙে যাবে।
ভারতকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তারা কি সত্যিকারের মিত্র হিসেবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পাশে থাকবে, নাকি একদলীয় সুবিধাবাদী রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে রাখবে। শেখ হাসিনার পতনের পর এই প্রশ্ন এখন ভারতের জন্য অস্তিত্বের প্রশ্নে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণ আজ আরও সচেতন, আরও রাজনৈতিকভাবে পরিণত। তারা বন্ধুত্ব চায়, কিন্তু দাসত্ব নয়; সহযোগিতা চায়, কিন্তু প্রভাব নয়। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করলে ভারত তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশীকে হারাবে।
সময় এসেছে ভারতের আত্মসমালোচনার। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে দিল্লির উচিত তার নীতি পুনর্গঠন করা। ইতিহাসের আদালতে শেখ হাসিনার মতোই ভারতের বর্তমান নীতিনির্ধারকরাও জবাবদিহি করবেন—কেন তারা এক স্বৈরাচারকে আশ্রয় দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক জাতিকে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছিল।
বাংলাদেশ আজ নতুন পথে হাঁটছে—গণতন্ত্র, মর্যাদা ও স্বাধীনতার পথে। এই পথে ভারত যদি সত্যিকারের মিত্র হতে চায়, তবে তাকে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে, কোনো দলের নয়। নইলে ইতিহাসের পাতা বলবে—ভারত তার একসময়ের বন্ধু জাতিকে হারিয়েছে অহংকার, অবিশ্বাস ও কূটনৈতিক ঔদ্ধত্যের কারণে।
রাজু আলীম
কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব