Image description

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ গণনার সঙ্গে সঙ্গে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনী রাজনৈতিক জোট গঠন প্রক্রিয়াও গতি পাচ্ছে। বিএনপি ইতোমধ্যেই বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে নিজেদের শরিকদের ৮টি আসনে নির্বাচনী সমঝোতা করেছে। অন্যদিকে, হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শক্তি ছাত্রদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোট গঠন প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোরালো গুঞ্জন আছে। যদিও বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। অন্যদিকে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এনসিপি, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন-এই তিন দলের সমন্বয়ে ৭ ডিসেম্বর একটি জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই জোটের নাম ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’।

সর্বশেষ শেখ হাসিনা পতনের অন্যতম প্রধান শক্তি ছাত্রদের সমন্বয়ে গড়া রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী জোট গঠনের গুঞ্জন ও তৎপরতার কথা শোনা যাচ্ছে কয়েকদিন ধরেই। কিন্তু জামায়াতে সঙ্গে আসন সমঝোতা বা নির্বাচনী জোট গঠনের এই চূড়ান্ত মুহূর্তে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের নারী নেত্রীরা। নারী নেত্রীদের বাধা বা হুমকির কারণেই এখন পর্যন্ত জোটটি আলোর মুখ দেখতে পারছে না।

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এনসিপি শাপলা কলি প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের মাঠে নেমেছে, শতাধিক আসনে প্রার্থীও ঘোষণা করেছে। তারা এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনকে নিয়ে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’ গঠন করলেও আরও দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

এদিকে, এনসিপি জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী আসন সমঝোতায় যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আবদুল কাদের। গতকাল বৃহস্পতিবার এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেছেন, সবকিছু ঠিক থাকলে শুক্রবার এই জোটের ঘোষণা আসতে পারে। তবে, জামায়াতের সঙ্গে জোট নিয়ে এনসিপির কোনো বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। 

আবদুল কাদের লিখেছেন, ‘তারুণ্যের রাজনীতির কবর রচিত হতে যাচ্ছে। এনসিপি অবশেষে জামায়াতের সাথেই সরাসরি জোট বাঁধতেছে। সারা দেশে মানুষের, নেতা–কর্মীদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে গুটিকয়েক নেতার স্বার্থ হাসিল করতেই এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামীকাল এই জোটের ঘোষণা আসতে পারে। আর এর মধ্য দিয়ে কার্যত এনসিপি জামায়াতের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।’

আবদুল কাদের দাবি করেন, জামায়াতের কাছে এনসিপি ৫০টি আসন চেয়েছিল, দর–কষাকষির পর ৩০ আসনে রফা হয়েছে। এই শর্ত অনুযায়ী এনসিপি বাকি ২৭০ আসনে কোনো প্রার্থী দিতে পারবে না। তিনি আরও দাবি করেন, নির্বাচনে জিতলে নাহিদ প্রধানমন্ত্রী হবেন, আর জিততে না পারলে বিরোধীদলীয় নেতা হবেন-এমন আলোচনাও রয়েছে।  

এদিকে, ৮ দলীয় ইসলামী জোট জানিয়েছে, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসসহ তাদের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মিলিয়ে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করার পথে এগোচ্ছে। জোট নেতারা বলেন, মনোনয়ন পত্র উত্তোলনের শেষ দিন পর্যন্ত যদি আনুষ্ঠানিক সমঝোতা ঘোষণা না হয়, তবুও তাদের মধ্যে আসনভিত্তিক সমঝোতা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এনসিপি সূত্রে জানা যায়, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার ব্যাপারে এনসিপির একটি অংশের সমর্থন আছে। তবে আরেকটি অংশেরও রয়েছে ঘোর আপত্তি। জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার আলোচনা সামনে আসার পর দলটির একাংশের মধ্যে প্রতিক্রিয়াও হয়েছে। বৃহস্পতিবার এনসিপি থেকে পদত্যাগ করেছেন জামায়াতবিরোধী অংশের নেতা হিসেবে পরিচিত মীর আরশাদুল হক।

জানা যায়, সদ্য দেশে প্রত্যাবর্তন করা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করতে এনসিপি সময় চাইলেও বিএনপি থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। আগামী ৩১ ডিসেম্বর বুধবার পর্যন্ত তারেক রহমানের সব কর্মসূচি নির্ধারণ করা আছে। ফলে নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করার শেষ হওয়ার আগে এনসিপির সঙ্গে বৈঠকের আর কোনো সুযোগ থাকছে না। 

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর তারেক রহমান সদ্য দেশে ফিরেছেন। দীর্ঘদিন তিনি দেশে না থাকায় রাজনীতির অন্দর মহলের অনেক বিষয় এখনও অবগত নন। এই মুহূর্তে তার সঙ্গে নির্বাচনী আসন নিয়ে দরকষাকষির জন্য কাউকে বসতে দেওয়াও উচিত নয়। 

বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতায় যেতে চাইলে দলটি কি কি সুবিধা দেবে, তা অতীতে দলের সিনিয়র নেতারা প্রকাশ্যে ও একাধিক বৈঠকেও জানিয়েছেন। নতুন করে বলার বা কোনো দলের ধরনা দেওয়ার কিছু নেই। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে সমঝোতার সুযোগ বা আসনের সংখ্যা কেবলই কমবেই, বাড়বে না। আগে সংখ্যাটা যেখানে অনধিক ৪০’র কাছাকাছি ছিল সেটা এখন সর্বোচ্চ ২০/২৫-এ নেমে এসেছে। সেক্ষেত্রে এনসিপির সঙ্গে বিএনপির আসন সমঝোতার সুযোগ আগে যেখানে ১০/১২টি ছিল সেখান থেকে এখন ৭, আরও দিন গেলে সেই সংখ্যাটি আরও কমতে পারে বলে বিএনপি সূত্র জানিয়েছে। 

অপরদিকে, এনসিপিকে জামায়াত ৩০ থেকে ৩৫টি আসন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। পাশাপাশি সমঝোতার এসব আসনে এনসিপির জন্য তাদের জনবল এবং আর্থিক সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়েছে হাসিনার পতনের পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখা দলটি। 

এনসিপি সূত্র জানায়, জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতা বা নির্বাচনী জোট গঠনের এই চূড়ান্ত মুহূর্তে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দলটির নারী নেত্রীরা। বৃহস্পতিবার এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বাসায় নির্বাচনী জোটের সিদ্ধান্ত নিতে বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে নারী নেত্রীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, জামায়াতের সঙ্গে জোট হলে তারা (নারী নেত্রীরা) প্রয়োজনে একসঙ্গে দল থেকে পদত্যাগ করবেন। সেই কারণে এনসিপি বা আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। 

এছাড়াও, হাসিনা বিরোধী আন্দোলন বা অভ্যুত্থানের অন্যতম শীর্ষ নেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া ও মাহফুজ আলমও চান না জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন করুক এনসিপি। কারণ নারীরা জোটবদ্ধ হয়ে ভেটো দিচ্ছেন। তাই জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিলে ‘জুলাই আন্দোলনের মূল শক্তি’ এনসিপির জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে।