বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তা, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রতিযোগী দেশের চাপ—সবকিছুর মাঝেও চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই–অক্টোবর) বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত সর্বশেষ দেশভিত্তিক পরিসংখ্যান বলছে, এই চার মাসে পোশাক রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি।
বিশ্বব্যাপী ক্রয়াদেশের ধীরগতি, মুদ্রাস্ফীতি ও ভোক্তা ব্যয় সংকোচনের মাঝে এই প্রবৃদ্ধিকে খাতটির জন্য একটি ‘টেকসই সংকেত’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে নন-ট্র্যাডিশনাল বা উদীয়মান বাজারের পতন ভবিষ্যতের জন্য কিছু সতর্ক সংকেতও দিচ্ছে।
ইউরোপই প্রধান গন্তব্য, প্রবৃদ্ধি কম হলেও স্থিতিশীল
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বরাবরের মতোই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাক আমদানিকারক অঞ্চল। চার মাসে ইইউতে রফতানি আয় হয়েছে ৬ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রফতানির ৪৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। যদিও প্রবৃদ্ধি মাত্র ০ দশমিক ৪৬ শতাংশ, বিশেষজ্ঞদের মতে এটি একটি ‘সতর্ক স্থিতিশীলতা’—যেখানে বাজার সংকোচনের পরও বাংলাদেশের পোশাকের চাহিদা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
ইইউ বাজারে মন্দা, মজুরি সংকট, ইনফ্লেশন এবং ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশ কিছুটা চাপে পড়লেও আয়ের এই সামান্য বৃদ্ধি খাতটির স্থিতিস্থাপকতার প্রমাণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আমেরিকার চাহিদা তুলনামূলক শক্তিশালী
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ পোশাক বাজার যুক্তরাষ্ট্র। চার মাসে দেশটিতে রফতানি দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রফতানির ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এখানে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ, যা ইইউর তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক আমদানির নতুন অর্ডার বাড়তে শুরু করেছে, বিশেষ করে ফাস্ট-ফ্যাশন এবং বেসিক পোশাক ক্যাটাগরিতে। তবে সাম্প্রতিক শুল্কনীতির সম্ভাব্য পরিবর্তন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনিশ্চয়তা ভবিষ্যতের জন্য কিছু ঝুঁকিও তৈরি করছে।
যুক্তরাজ্য ও কানাডা: স্থায়ী ক্রেতাদের বাজারে ইতিবাচক গতি
দুই বড় প্রচলিত বাজার—যুক্তরাজ্য ও কানাডা—এ বছরও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।
কানাডা: ৪৪২ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার আয়, প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
যুক্তরাজ্য: ১ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার আয়, প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭২ শতাংশ।
কানাডায় উচ্চ প্রবৃদ্ধি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দেশটির বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আগের তুলনায় আরও বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উদীয়মান বাজারে পতন: ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে অপ্রচলিত বা উদীয়মান বাজার—যেমন অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন, রাশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা—এসব দেশে বাজার সম্প্রসারণের চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু জুলাই–অক্টোবর সময়ে এসব বাজারে রফতানি কমেছে ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, বৈশ্বিক মন্দা, রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞাজনিত জটিলতা, লজিস্টিক ব্যয় বৃদ্ধি এবং কিছু দেশে মুদ্রা সংকট—এসব কারণে ক্রয়াদেশ কমেছে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাজার বৈচিত্র্যকরণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে। বিশেষ করে ভবিষ্যতের জন্য পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারগুলোকে শক্তিশালী করার উপযোগী কৌশল নিতে হবে।
ওভেন পোশাকে এগিয়ে
তৈরি পোশাক রফতানির দুই প্রধান অংশ নিটওয়্যার ও ওভেন—উভয় ক্ষেত্রেই প্রবৃদ্ধি হলেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা গেছে বোনা পোশাকে।
নিটওয়্যার: ০ দশমিক ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি
ওভেন: ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি
নিটওয়্যারের তুলনায় ওভেন পোশাকে তুলনামূলক ভালো পারফরম্যান্স ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ইউরোপ-আমেরিকায় বোনা পোশাকের চাহিদা ফের বাড়ছে।
চার মাসের রফতানি প্রবৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক হলেও এটিকে ‘সতর্ক সম্ভাবনা’ হিসেবে দেখছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি। উৎপাদন ব্যয়, জ্বালানি পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক শুল্কনীতি এবং প্রতিযোগী দেশ—ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও ভারত—তাদের নতুন বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে দ্রুত এগোচ্ছে।
বাংলাদেশকে তাই এগিয়ে থাকতে হলে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি, প্রযুক্তি ও অটোমেশন বিস্তার, মূল্য সংযোজন বাড়ানো, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন এবং নতুন বাজারে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্যোগ জোরদার করার বিকল্প নেই।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক ও ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্ববাজার ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধারের দিকে গেলেও বাংলাদেশের সামনে রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। ক্রেতাদের চাহিদা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তাই আমাদের এখনই বাজার বৈচিত্র্য, পণ্যের মানোন্নয়ন এবং ক্রেতাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতা গড়ে তুলতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাত দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি নির্বাহক হিসেবে এখনও শক্ত অবস্থানে রয়েছে। জুলাই-অক্টোবরের প্রবৃদ্ধি আশা জাগালেও নন-ট্র্যাডিশনাল বাজারে পতন উদ্বেগজনক। এখন প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও ব্যবসাবান্ধব নীতি সহায়তা।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আগামী দিনে সম্ভাবনার পাশাপাশি চাপে থাকবে—এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে চার মাসের রফতানির এই চিত্র। স্থায়ী বাজারে অল্প প্রবৃদ্ধি এবং উদীয়মান বাজারে পতন—দুটি দিকই খাতটিকে সতর্ক করে দিচ্ছে। তবে সামগ্রিক রফতানি বৃদ্ধি দেখাচ্ছে যে সঠিক নীতি, বাজার বৈচিত্র্য ও উৎপাদন দক্ষতা বাড়াতে পারলে বাংলাদেশ এখনও বিশ্ববাজারে শক্ত প্রতিযোগী হিসেবে টিকে থাকতে পারবে।