Image description
নতুন পরিকল্পনা অধ্যাদেশ অনুমোদন । এটি কার্যকর হলে দেশে পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন ঘটবে । অপরিকল্পিত উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ হলে বছরে কয়েক শ কোটি টাকার অপচয় রোধ হবে ।

স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও দেশের ৮৪ শতাংশ এলাকার পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য কোনো মহাপরিকল্পনা (মাস্টার প্ল্যান) প্রণয়ন করা হয়নি। যে ১৬ শতাংশ এলাকার জন্য মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছে, বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা না থাকায় সেসব এলাকায়ও কার্যকর সুফল মেলেনি। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৩০ অক্টোবর ‘স্থানিক পরিকল্পনা অধ্যাদেশ-২০২৫’ অনুমোদন করেছে। এর আওতায় সারা দেশের জন্য তিন স্তরের মাস্টার প্ল্যান (জাতীয় পরিকল্পনা, আঞ্চলিক পরিকল্পনা ও স্থানীয় পরিকল্পনা) প্রণয়ন করবে। আইনি কাঠামোর আওতায় তৈরি এসব মাস্টার প্ল্যানের বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা থাকবে। এটা কার্যকর হলে দেশে পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন ঘটবে। কৃষিজমি ও জলাভূমি ধ্বংস হ্রাস পাবে এবং পরিবেশের উন্নয়ন ঘটবে বলে অভিমত নগর বিশেষজ্ঞদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সময়ে দেশের যে অংশের মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে, এর সবকটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়নি। আবার যেগুলোর গেজেট হয়েছে, তারও বাস্তবায়ন করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে ওই মাস্টার প্ল্যানকে তোয়াক্কা করা হয়নি। এটা করতে পেরেছে নগর পরিকল্পনাসংক্রান্ত কোনো আইন না থাকার কারণে।

দেশকে পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে তুলতে ১৯৬৫ সালে তৎকালীন সরকার নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর (ইউডিডি) প্রতিষ্ঠা করে। এ সংস্থার প্রধান কাজ ছিল নগর পরিকল্পনা সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা। এটি দেশের ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংবিধানস্বরূপ। অর্থাৎ প্রতি ইঞ্চি জমির কী ব্যবহার হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা থাকবে ওই পরিকল্পনায়। সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার ৬০ বছর পর সে পথে হাঁটল বর্তমান সরকার। বিগত দিনের সরকারগুলো নগর পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দেয়নি। তবে পরিকল্পনাবিদরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হওয়ায় স্থানিক পরিকল্পনা অধ্যাদেশ পাশ হয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান যুগান্তরকে বলেন, সব দেশে নগর পরিকল্পনা আইন রয়েছে। এর আলোকে দেশের সমগ্র এলাকার মাস্টার প্ল্যান করে তার ভিত্তিতে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এতদিন বাংলাদেশে ওই আইনটি না থাকায় দেশে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু মাস্টার প্ল্যান হলেও তা থেকে কার্যত তেমন কোনো সুফল মেলেনি। তিনি জানান, স্থানিক পরিকল্পনা অধ্যাদেশের আওতায় জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। এগুলো মেনে সব সংস্থাকে প্রকল্প গ্রহণ এবং উন্নয়নকাজ করতে হবে। ফলে দেশের অপরিকল্পত উন্নয়ন বন্ধ করে বছরে শত শত কোটি টাকার অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি কৃষিজমি, জলাভূমি ও পরিবেশ সুরক্ষা পাবে।

তিনি আরও জানান, স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও পরিকল্পনা আইন না হওয়ায় দেশের জন্য দুঃখজনক ব্যাপার ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্থানিক পরিকল্পনা নামে নগর পরিকল্পনা আইন প্রণয়ন করায় ধন্যবাদ জানান তিনি। এই আইনে অনেক ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে। তারপরও তারা আপাতত মেনে নিচ্ছেন। ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে আইনটিকে আরও যুগোপযোগী করা যাবে বলে অভিমত তার।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব মো. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে তা অনুমোদন করেছে। এ আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে দেশে পরিকল্পিত উন্নয়নের প্রসার ঘটবে। কৃষিজমি ও জলাশয় ধ্বংস হ্রাস হবে এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা পাবে।

স্থানিক পরিকল্পনা আইনে যা রয়েছে : এ আইনের শুরুতে বলা হয়েছে-দ্রুত নগরায়ণের ফলে দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ বড় শহরগুলোয় স্থানান্তরিত হচ্ছে। শহরাঞ্চলের জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়ছে। নাগরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে মূল্যবান কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ-ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শহর ও গ্রামীণ জনপদগুলো বহুমাত্রিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন এবং পরিকল্পিত দেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলবায়ু ও দুর্যোগ সংবেদনশীলতা, সামাজিক ন্যায্যতা, কৃষি ও জলাশয় সুরক্ষায় জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা আবশ্যক ছিল।

জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা : এটি দেশের একটি দীর্ঘমেয়াদি ও কৌশলগত স্থানিক পরিকল্পনা দলিল। এটি দেশের সমগ্র ভৌগোলিক এলাকায় (সমুদ্রসীমাসহ) প্রণয়ন করা হবে। এ পরিকল্পনা জাতীয় আর্থসামাজিক লক্ষ্যমাত্রা এবং সেক্টরাল নীতিমালার স্থানিক প্রতিফলন ঘটায়। পাশাপাশি ভূমি ও সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক করিডর স্থাপনের বিষয়ে কৌশলগত দিকনির্দেশনা দেবে।

আঞ্চলিক স্থানিক পরিকল্পনা : জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনার আওতায় কোনো নির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক বিভাগ বা বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অঞ্চলের (হাওড়, উপকূলীয় বা পার্বত্য অঞ্চল) জন্য মধ্যম স্তরের কৌশলগত পরিকল্পনা। এই মাস্টার প্ল্যান আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করা হয়। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার স্বতন্ত্র সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সমন্বিত উন্নয়নের রূপরেখা প্রণয়ন করে।

স্থানীয় পর্যায়ের স্থানিক পরিকল্পনা : আঞ্চলিক স্থানিক পরিকল্পনার আলোকে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসমূহ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা সংশ্লিষ্ট এলাকার জন্য স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান, স্ট্রাকচার প্ল্যান, আরবান এরিয়া প্ল্যান, ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করবে।

স্থানিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি : নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরসহ (ইউডিডি) আইন ও বিধিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো স্থানিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে। তবে স্থানিক পরিকল্পনাবিষয়ক আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশ জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা পরিষদ, আঞ্চলিক, স্থানীয় ও বিশেষ স্থানিক পরিকল্পনা সংশোধনসহ বা সংশোধন ছাড়া অনুমোদন করবে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রীর নেতৃত্বে ২৬ সদস্যের জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা পরিষদ থাকবে। আর গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিবের নেতৃত্বে ২৬ সদস্যবিশিষ্ট স্থানিক পরিকল্পনাবিষয়ক আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি থাকবে এবং মাঠ পর্যায়ে ডিসির নেতৃত্বে ১১ সদস্যবিশিষ্ট জেলা স্থানিক পরিকল্পনা কমিটি থাকবে।

দেশের ৮৪ ভাগ এলাকায় নেই মাস্টার প্ল্যান : দেশের ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬১০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যে ২৩ হাজার ২৯ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। যেটা দেশের মোট আয়তনের মধ্যে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ অর্থাৎ এখনো ৮৪ শতাংশ অঞ্চল মহাপরিকল্পনার বাইরে রয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থাগুলোর মধ্যে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের (ইউডিডি) আওতায় ১৩ হাজার ৬৬৪ দশমিক ৩৪ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের ৩৬টি মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪টি জেলা শহর, ৩৩টি উপজেলা ও উপজেলা শহর এবং পায়রা বন্দরের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) নিজস্ব এখতিয়ারভুক্ত ৬ হাজার ৩৬০ দশমিক ৫৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার পরিকল্পনা তৈরি করেছে। ইউডিডি এবং উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মিলে ২০ হাজার ২৪ দশমিক ৮৯ বর্গকিলোমিটার এলাকার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে, যেটা দেশের মোট আয়তনের ১৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ২১৬টি পৌরসভার ৩০০৪ দশমিক ১১ বর্গকিলোমিটার এলাকার মহাপরিকল্পনা করেছে, যেটা দেশের মোট আয়তনের ২ দশমিক ০৩ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা অধ্যাদেশ-২০২৫ গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। আর ৩০ অক্টোবরের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশটির চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়। শিগগিরই অধ্যাদেশটি গেজেটভুক্ত হবে। এরপর এর বিধিমালা প্রণয়ণ করা হবে। তারপর ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন শুরু করা হবে।