চব্বিশের জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলে নোটিশ পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
তামীম বলেন, ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে প্রথম এমন কম্পেনসেশনের রায় দেয়া হয়েছে। এখন এ রায়ের কপি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গেলে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন যে এর কোন অংশ কিভাবে কার্যকর করবেন। তবে পলাতক দুই আসামির বিরুদ্ধে আগেই একটি গ্রেফতারি পরোয়ানাসহ রেড নোটিশ জারির আবেদন করা আছে। এখন গ্রেফতারি পরোয়ানার বদলে কনভিকশন ওয়ারেন্ট বা সাজার পরোয়ানামূলে ইন্টারপোলে আরেকটি নোটিশ জারির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হবে। তাদের মাধ্যমে এটা ইন্টারপোলে যাবে। এ নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে প্রসিকিউশন।
তিনি বলেন, পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায় ঘোষণা হয়েছে সোমবার। এ রায়ের একটি সার্টিফাইড কপি পাবে প্রসিকিউশন। একই সাথে গ্রেফতার আসামিও পাবেন। এ ছাড়া পলাতকরা যদি ৩০ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ বা গ্রেফতার হন তাহলে তারাও একটি কপি পাবেন বিনামূল্যে। এটার কার্যকরিতার জন্য এ রায়ের আরেকটি কপি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তথা ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে যাবে। এসব রায়ের শেষে উল্লেখ রয়েছে।
কবে নাগাদ রায়ের কপি যাবে; এমন প্রশ্নে প্রসিকিউটর বলেন, ১৭ নভেম্বর রায় দেয়া হয়েছে। এখন এ রায়ের কিছু অফিসিয়াল কার্যক্রম রয়েছে। সেসব সম্পন্ন হলেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে চলে যাবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সোমবার হাসিনা ও কামালের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সাথে রাজসাক্ষী মামুনের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে করা মামলায় এটিই প্রথম রায়।
ট্রাইব্যুনালে আরো তিন মামলা আছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে : এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধে পলাতক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক মামলায় মৃত্যুদণ্ড হলেও তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরো তিনটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে গুমের দু’টি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। আর শাপলা চত্বরে হত্যামামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও আদালত অবমাননার অভিযোগে এ বছরের জুলাইতে ছয় মাসের কারাদণ্ড হয়েছিল শেখ হাসিনার।
মৃত্যুদণ্ডের মামলা : জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে বিভিন্ন অভিযোগে ১৭ নভেম্বর স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আর দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে পাঁচ বছরের দণ্ড দিয়েছেন।
আদালত অবমাননায় দণ্ড : ‘২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি’ শেখ হাসিনার এমন একটি বক্তব্যের অডিও রেকর্ড অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। তার ওই বক্তব্য বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা উল্লেখ করে প্রসিকিউশন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনে। সেই মামলায় শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল।
গুমের দুই মামলা : চলতি বছরের ৮ অক্টোবর বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে আলোচিত গুমের ঘটনায় প্রথমবারের মতো ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৮ জনের বিষয়ে দু’টি ফরমাল চার্জ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
ওই দিন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, গুম, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ডসহ নানান ধরনের যে অপরাধ হয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে এই প্রথম দু’টি ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে। সেই ফরমাল চার্জ উপস্থাপন করেছি। ট্রাইব্যুনাল সবগুলোর বর্ণনা শুনেছেন। এরপর আসামিদের বিরুদ্ধে কগনিজেন্স নিয়েছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যু করেছেন।
দু’টি অভিযোগের মধ্যে একটি হলো গত ১৫ বছরে র্যাবের কিছু বিপদগামী সদস্য টিএফআই সেল এবং বিভিন্ন গোপন বন্দিশালায় ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, ব্লগারকে আটক রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। এমন হাজারো অভিযোগের মধ্য থেকে যেগুলো ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে। এর বাইরে ডিজিএফআইয়ের কিছু বিপথগামী সদস্য যারা জেআইসি নামক যে সেন্টারটি আছে সেটিকে অপব্যবহার করে রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের আটক রেখেছিল। সেটার ব্যাপারে আলাদা ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে। এ ঘটনার সাথে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীসহ র্যাব ও ডিজিএফআইয়ের বেশ কিছু অফিসার যারা আসামি তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এরপর ১৭ নভেম্বর এই দুই মামলার কয়েকজন আসামি সেনা কর্মকর্তা আদালতে হাজির হন। এরপর আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এই দু’টি মামলার পরবর্তী শুনানি আগামী ২৩ নভেম্বর।
শাপলা চত্বর : ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবর অভিযোগ করেন হেফাজতে ইসলামের নেতা আজিজুল হক। হেফাজত নেতা জুনায়েদ আল হাবিব ও মাওলানা মামুনুল হকের পক্ষে তিনি এ অভিযোগ করেন। এ ঘটনায় ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
তারা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক এমপি হাজি সেলিম, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহমেদ, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, কমিটির সদস্য অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ, গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার, একাত্তর টিভির সাবেক সিইও মোজাম্মেল হক বাবু, সময় টিভির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আহমেদ জোবায়ের, এবিনিউজ২৪ ডটকমের সম্পাদক সুভাষ সিংহ রায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাইমুল ইসলাম খান, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও এনএসআইয়ের মো: মনজুর আহমেদ। গত ১২ নভেম্বর এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বাড়িয়ে ১২ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছে।