
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতা রাজনৈতিক মহলে বিশেষ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিষয়গুলো নিয়ে বেশ সরব। সরকারও আমলে নিচ্ছে। এমন কূটনৈতিক তৎপরতা সামনে জটিল কোনো রাজনৈতিক সংকটের আভাস দিচ্ছে কি না সেদিকে চোখ সবার।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের ‘অনুপ্রবেশ’ শুরু হয়। রাজনীতিতে এর প্রভাব ইতিবাচক না নেতিবাচক ফল বয়ে এনেছে তা নিয়ে তর্ক থাকলেও প্রকাশ্যে সব রাজনৈতিক দলের অভিন্ন বক্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ও ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক কার্যালয়ের রাজনৈতিক তৎপরতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানামুখী আলোচনা। এই আলোচনা প্রকাশ্যের চেয়ে গোপনেই বেশি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাতের বিষয়টি।
বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকেই ২০০৬-০৭ সালের রাজনৈতিক সংকটের মিল খুঁজে পাচ্ছেন, যা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনিবার্য করে তোলে। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিস, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী এবং ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনাটা লক ডেসালিয়ান ছিলেন সে সময়কার আলোচিত নাম। রাজনীতিতে তাদের হস্তক্ষেপ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা সত্য প্রমাণিত হয় উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিসের তারবার্তা থেকে।
তারবার্তায় জানা যায়, সে সময় ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা কূটনীতিকরা ‘কফি গ্রুপ’ নামে একটি বৈঠক বসাতেন। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, জাতিসংঘের প্রতিনিধি এবং আমন্ত্রণপত্রপ্রাপ্ত জাপান অংশ নিতো। এসময় তারা বাংলাদেশের রাজনীতি ‘পর্যালোচনা’ করতেন।
বরাবরের মতো এবারও বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা কলোনিয়ান মনোভাব থেকেই আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন। অথচ এটা তাদের দায়িত্ব নয়। আর আমাদের রাজনৈতিক নেতারাও নিজেদের স্বার্থে সেটা গ্রহণ করেন।- কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
তবে সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন ড্যানিলোভিচ গত ৭ মার্চ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, “প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস কিংবা আমার সহকর্মীরা এক/এগারো ঘটাননি। আমি মনে করি না, কোনো গোপন ‘কফি গ্রুপ’ সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাংলাদেশের জনগণকে বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিয়েছিল।”
‘তখন (সেনাসমর্থিত সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে) অবশ্যই বাংলাদেশ যে পথে এগোচ্ছিল, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও সেনাবাহিনীর মতো আমাদেরও লক্ষ্য একই রকম ছিল,’ বলেন তিনি।
যদিও তিনি স্বীকার করেন, ২০০৭–০৮ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যুক্তরাষ্ট্র জনগণের প্রত্যাশার চেয়ে জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের ভাবনাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব ছিল নির্বাচনের সময়সীমার ওপর।
তার ভাষায়, ‘ওই সময়ে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে বড় ভুল ছিল।’
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেওয়ার ঘটনা ওয়ান/ইলেভেন বা এক/এগারো নামে পরিচিত। জন ড্যানিলোভিচ ওই সরকারের আমলে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন।
সে সময় বিউটিনিস, আনোয়ার চৌধুরী, রেনাটা লক ডেসালিয়ান একের পর এক বৈঠক করেন খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সঙ্গে। নির্বাচন পেছানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয় খালেদা জিয়াকে। কিন্তু তিনি রাজি হননি।
শেষ পর্যন্ত জরুরি অবস্থা জারি করে উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং ১২ জানুয়ারি ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে নতুন আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।
প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
আর আনোয়ার চৌধুরী ‘এতে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে’ বলে উল্লেখ করেন। কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেয়।
‘সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ বইয়ে প্রয়াত বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের প্রভাবের বিষয়ে প্রথম অধ্যায়ে লিখেছেন, ’…জনগণের মধ্যে ব্যাপক ধারণা জন্মেছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য উভয়ের রাষ্ট্রদূত নির্বাচন বাতিল করে জরুরি অবস্থা জারিতে উৎসাহ জুগিয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের এজেন্সিগুলো।’
আলোচনায় ট্রেসি জ্যাকবসন, গোয়েন লুইস, হুমা খান
বাংলাদেশে এখনকার আলোচনার কেন্দ্রে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস ও তার কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান।
গত কয়েক সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের এই প্রতিনিধিরা একাধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন।
জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ট্রেসি জ্যাকবসন। বিএনপির পক্ষ থেকে এই বৈঠকের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন তারেক রহমানের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবীর।
কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নয়, আমরা মূলত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। কারণ, কোনো ব্যক্তি রাজনৈতিক দলের সদস্য হলেই তার ভুক্তভোগিতা অস্বীকার করা যায় না। আমরা সেই ভুক্তভোগিতার পাশে আছি এবং থাকবো।- জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে থাকা অবস্থায় লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারা কুকও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা করতে তৃতীয় কোনো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকের ছুটে যাওয়ার এমন ঘটনা নজিরবিহীন।
যদিও এটি তাদের কূটনৈতিক কার্যক্রমের নিয়মিত অংশ উল্লেখ করে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র আশা বে জাগো নিউজকে বলেন ‘বাংলাদেশের অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক পরিসরের সব অংশীদারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে।’
লন্ডন সফর শেষে দেশে ফিরে ট্রেসি এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আপ্যায়ন করেন। এরপর তিনি ডানপন্থি দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি তিনি দেশের প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।
তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘আলাপ-আলোচনা’র নামে বিদেশি কূটনীতিকরা যা করছেন তা স্পষ্টত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বরাবরের মতো এবারও বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা কলোনিয়ান মনোভাব থেকেই আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন। অথচ এটা তাদের দায়িত্ব নয়। আর আমাদের রাজনৈতিক নেতারাও নিজেদের স্বার্থে সেটা গ্রহণ করেন।’
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টিসহ বেশ কয়েকটি ইসলামপন্থি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস ও তার কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান।
এসব বৈঠকের বিষয়ে নানা আলোচনা সমালোচনার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে হুমা খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নয়, আমরা মূলত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। কারণ, কোনো ব্যক্তি রাজনৈতিক দলের সদস্য হলেই তার ভুক্তভোগিতা অস্বীকার করা যায় না। আমরা সেই ভুক্তভোগিতার পাশে আছি এবং থাকবো।’
‘ত্রুপের তাস’ জাতিসংঘ মিশন
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সম্ভাব্য গণঅভ্যুত্থান দমনের চেষ্টা হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে জাতিসংঘ সতর্ক করেছিল। এ তথ্য জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক ‘বিবিসি হার্ডটক’-এ জানান। যদিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে।
২০০৬-০৭ সালের রাজনৈতিক সংকটেও যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ইয়াজউদ্দিন আহমদ একতরফা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছিলেন, তখনও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে হুমকি আসে।
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের বিশেষ দূত ক্রেইগ জেনেস ঢাকায় এসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর সতর্ক করেন, চলমান রাজনৈতিক সংকটের প্রভাব শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ওপর পড়তে পারে।
২০০৭ সালের জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা কূটনীতিকদের তৎপরতা বাড়ে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী, একতরফা নির্বাচন হলে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ঝুঁকিতে পড়বে।
এই প্রেক্ষাপটে তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ পরবর্তীসময়ে তার ‘শান্তির স্বপ্নে’ বইয়ে লেখেন, ‘সেনাবাহিনীর সীমিত আয়ের চাকরিতে সৈনিকদের প্রধান ভরসা জাতিসংঘ মিশন। সেই সুযোগ হারালে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যেত।’
পিটার হাস ও ডোনাল্ড লু
বাংলাদেশের রাজনীতি ও কূটনীতিতে ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আলোচিত চরিত্র। দুই বছর চার মাস এদেশে দায়িত্ব পালনকালে পুরোটা সময়জুড়ে তিনি ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচন, মানবাধিকার পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক সহনশীলতা নিয়ে তার মন্তব্য এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠক রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
পাশাপাশি আলোচনা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু-কে নিয়ে।
দফায় দফায় বাংলাদেশ সফর করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন ডোনাল্ড লু এবং যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার। কিন্তু নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে রাজি করাতে পারেননি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
ড্যান মজীনা, সুজাতা সিং, তারানকো
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করলে এর প্রতিবাদে ২০১৩ সালে বিএনপির আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। হরতাল, অবরোধ ও সংঘর্ষে অচল হয়ে পড়ে দেশ। সেসময় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সমঝোতার আশায় ডিসেম্বরের শুরুতে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। ততদিনে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়ে গেছে।
বিএনপির একটি সূত্রের বরাতে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন জানায়, শেখ হাসিনাকে সরকারপ্রধান রেখেই একটি নির্বাচন ফর্মুলা দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন তারানকো, তবে বিএনপি তাতে সাড়া দেয়নি।
তারানকো বৈঠক করেন শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও দুই দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে। এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির মহাসচিবকে এক টেবিলে বসান, যা ছিল নজিরবিহীন।
তবুও দুই পক্ষই অনড় থাকে। বিদায়ের আগে সোনারগাঁও হোটেলে সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে তারানকো জানান, আলোচনায় আগ্রহ দেখিয়েছে উভয় দল। তবে মুখের কথার চেয়ে চোখের হতাশাই ছিল বেশি স্পষ্ট।
ঠিক একই সময়ে ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর একদিনের সফরে ঢাকায় আসেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং।
পররাষ্ট্র সচিব হয়েও তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। এছাড়া বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদসহ আরও অনেকের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
বলা হয়, কোনো রাখঢাক ছাড়াই জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি করান সুজাতা সিং।
সুজাতা ফেরার পরপরই মহাজোট সরকার থেকে জাতীয় পার্টির মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং উপদেষ্টারা পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে সমালোচিত বিরোধীদল।
স্যার নিনিয়ান ও জিমি কার্টার
এর আগে ১৯৯৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশের রাজনীতি চরম উত্তপ্ত হয়ে উঠলে সমঝোতার লক্ষ্যে ঢাকায় আসেন কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টেফান।
তিনি সরকার, বিরোধীদল ও একজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী নিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। সরকার ইতিবাচক ইঙ্গিত দিলেও, পক্ষপাতের অভিযোগে আওয়ামী লীগ তা প্রত্যাখ্যান করলে তিনি ঢাকা ছাড়েন। এরপর একতরফা নির্বাচন হলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা আসে। এরই ধারাবাহিকতায় আসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অবিশ্বাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ঢাকায় এসে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে জানান, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রধান বাধা দুই দলের দ্বন্দ্ব ও সহিংসতা। শেষ পর্যন্ত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে।