
শুল্ক জটিলতা কেটে হিলিসহ বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা চাল ট্রাক থেকে খালাস হওয়া শুরু হয়েছে। গত কয়েক দিনে বিভিন্ন বন্দরে বিপুল পরিমাণ চাল আটকে ছিল। এর মধ্যে হিলি বন্দরে শতাধিক ট্রাকে অন্তত চার হাজার মেট্রিক টন চাল আটকে ছিল।
মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে আমদানিকৃত চাল ভারতীয় ট্রাক থেকে খালাস শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু হলেও দেশের বাজারে চালের দাম কমছে না। বরং নতুন করে চিকন চালের দাম বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত দুই দিনের সরু জাতের চালের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ টাকা।
মঙ্গলবার বিকেলে কারওয়ান বাজারের চাঁদপুর রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী বাচ্চু মিয়া আমার দেশকে বলেন, সোমবার থেকে মিল মালিকরা নতুন করে বস্তাপ্রতি ৫০ টাকা পর্যন্ত চালের দাম বাড়িয়েছেন। তেজগাঁও এলাকার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী জনতা রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী হাজী মো. আবু ওসমান মিল গেটে চালের দাম বাড়ানোর একই ধরনের তথ্য জানিয়েছেন।
রাজধানীর বড় পাইকারি বাজার বাবুবাজারের ইসলাম রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আমজাদ হোসেন বলেন, খুলনা অঞ্চলের আমদানিকারক মজুমদার ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের আকবরসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী আমদানিকারক রয়েছেন— যারা সরকার অনুমতি দিলে বরাবরই বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করেন, কিন্তু গুদামে মজুত রাখেন। এরপর আমদানি অনুমতি বন্ধ হয়ে গেলে তারা ধীরে ধীরে বাড়তি দামে চাল বাজারে সরবরাহ করেন। ফলে এ বিষয়ে সরকারকে মনিটরিং বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, আমদানির খবরে চালের দাম এখনো কমেনি। তবে আশা করছি, আমদানিকৃত চাল বাজারে এলে কিছুটা হলেও কমতে পারে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল বলেন, সরকার চাল আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারে আগের মতো শুধুমাত্র ২ শতাংশ আয়করের পরিপত্র জারির বিষয়টি কাস্টমসের সার্ভারে কার্যকর হওয়ার পর থেকে আমদানিকারকরা ট্রাক থেকে চাল খালাস করতে শুরু করেছেন। শুল্ক জটিলতায় হিলি বন্দরে শতাধিক ট্রাকে অন্তত চার হাজার মেট্রিক টন চাল আটকে ছিল। তা এখন খালাস হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে চাল আমদানির অপেক্ষায় ভারতে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০টি চালবোঝাই ট্রাক ওপারে দাঁড়িয়ে আছে পাইপলাইনে।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী চাল আমদানির ক্ষেত্রে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ছাড়া অন্য কোনো শুল্ক-কর আরোপযোগ্য নয়।
দেশের বাজারে চালের সরবরাহ স্বাভাবিক ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির জন্য সারাদেশের ২৪২ জন আমদানিকারককে চাল আমদানির বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এর পর গত ১২ আগস্ট থেকে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু হলেও ৭ দিনে ব্যবসায়ীরা খালাস করতে পারেননি।
আমদানিকৃত সরু জাতের চাল ৬৭ থেকে ৭০ টাকা আর মোটা চালের দাম ৫০ থেকে ৫২ টাকার মধ্যে থাকবে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা।
এর আগে ২৩ জুলাই থেকে শুরু করে ৭ আগস্ট পর্যন্ত চাল আমদানির অনুমতি চেয়ে আমদানিকারকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রথম ধাপে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চাল আমদানির জন্য দেশের ২৪২টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে ৫ লাখ টন চাল আমদানির বরাদ্দ প্রদান করা হয়। এর মধ্যে সিদ্ধ চাল রয়েছে ৪ লাখ ৬১ হাজার টন আর আতপ চাল রয়েছে ৩৯ হাজার টন। চালে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভাঙা দানা থাকতে পারবে। হিলি স্থলবন্দর দিয়ে প্রায় ১ লাখ টন চাল আমদানির জন্য বরাদ্দ পেয়েছেন হিলি, বিরামপুর, দিনাজপুরসহ আশপাশের আমদানিকারকরা।
হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের নেতা নাজমুল বলেন, বেসরকারি পর্যায়ে ভারত থেকে চাল আমদানি শুরুর ফলে দেশে যে মিলাররা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেটি কমে আসবে।
এদিকে ভারতের সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণার পর বিভিন্ন চালের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশের ৫ লাখ টন শুল্কমুক্ত চাল আমদানির ঘোষণার পর ভারতে চালের বাজারে বিভিন্ন ধরনের চালের দাম ১৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
সংবাদমাধ্যমটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভোক্তা পর্যায়ে স্বর্ণা চালের দাম প্রতি কেজি ৩৪ রুপি থেকে বেড়ে ৩৯ রুপি, মিনিকেট ৪৯ রুপি থেকে বেড়ে ৫৫ রুপি, রত্না চাল ৩৬–৩৭ রুপি থেকে বেড়ে ৪১–৪২ রুপি এবং সোনা মসুরি ৫২ রুপি থেকে বেড়ে ৫৬ রুপি কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
ভারতের চাল রপ্তানি ও বিপণন প্রতিষ্ঠান রাইসভিলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুরজ আগরওয়াল গণমাধ্যমকে বলেন, গত বুধবার দুপুরে বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর সেদিন রাত থেকেই ভারত থেকে চালের ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে। তিনি আরও জানান, পরিবহন খরচ ও সুবিধার কারণে উত্তরপ্রদেশ এবং দক্ষিণ ভারতের চালকলগুলোও পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে চাল রপ্তানি করছে।
পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ ও দক্ষিণ ভারতের ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই বাংলাদেশের শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে অবহিত ছিলেন। তাই তারা পেট্রাপোল সীমান্তের গুদামে চাল প্রস্তুত রেখেছিলেন।
২০২৪–২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে চালের দাম ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ১৩ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখতে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ সরকার শুল্কমুক্ত চাল আমদানির ফের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।