
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র ও রামপুরা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর পলাতক আওয়ামী লীগ ক্যাডার আব্দুস সবুর লিটনের ইশারায় এখনো চলে হালিশহর।
যিনি দুই মেয়াদে কাউন্সিলর থেকে একরের পর একর জমি দখল করে, বাগানবাড়ি, গাড়িসহ কয়েকশ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। অথচ এই লিটন এক সময় বিড়ি কোম্পানির শ্রমিক ছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের নির্দেশে অস্ত্র নিয়ে নিজেও মাঠে নামেন। সেই সঙ্গে আন্দোলন দমাতে বিশাল ক্যাডার বাহিনীও পরিচালনা করেন লিটন। তার বিরুদ্ধে আছে শত শত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি, স্বেচ্ছাচারিতা, ইয়াবা ব্যবসা, নকল ব্র্যান্ডরোল দিয়ে সিগারেট ব্যবসা, ডিস ও ইন্টারনেট, পানি, ইট-বালুসহ বিভিন্ন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য এবং দখলবাজির অভিযোগ।
অভিযোগ উঠেছে, ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন হলে হালিশহর থানা আওয়ামী লীগের এই ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক গা ঢাকা দেন। ওইদিন থেকে লিটনকে আর কোথাও দেখা যায়নি। একটি সূত্র বলছে, বিভিন্ন দিক ম্যানেজ করে নওফেলের সহযোগিতায় তিনি দুবাইয়ে পালিয়ে গেছেন ওই বছরের আগস্টেই।
তবে লিটনের অদৃশ্য হাত থেমে নেই। তার ইশারায় এখনো চলছে হালিশহর থানা এলাকা। অনুসারীদের দিয়ে মামলা করিয়ে ব্যবসা ও দখল করা সম্পত্তি ধরে রাখার চেষ্টাও করছেন লিটন। তার ভয়ে এখনো তটস্থ হালিশহরের বাসিন্দারা।
সম্প্রতি তার অনুসারী কিশোর গ্যাং সেলের প্রধান ওয়ার্ড যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান পলাশের ঘনিষ্ঠ ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. রিপন ২০ লাখ টাকা মূল্যের মালামাল চুরির মামলা দিয়ে আহমেদ সজীব ও মনির হাসান নামে দুই যুবককে জেলে দিয়েছেন।
তাছাড়াও চাঁদাবাজির মামলা দিয়ে অন্তত ছয়জনকে জেল খাটান তিনি। আরো দুজন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এরা হলেন, মো. ইব্রাহিম সাজ্জাদ ও মো. রাজু।
রাজুর বাবা জানান, তার ছেলে রাজু যুবলীগ নেতা রিপনের ইন্টারনেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। কিন্তু লিটনের নির্দেশে রিপন তাকে নানান জায়গায় জড়িয়ে ফেলছে। এসব কারণে সে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে চাইলে রিপন ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে মিথ্যা চুরির মামলায় জড়িয়ে দেয়। একইভাবে সাজ্জাদকেও আসামি করে।
রিকশা চালক ওসমান গণি জানান, আমার ছেলে মনির হাসান চাকরি ছেড়ে দেবে বললে তাকে গ্রেপ্তার করিয়ে দেয় রিপন। তার এক ভাই পুলিশে চাকরি করে। তাছাড়া সে আব্দুস সবুর লিটনের লোক। ৬ বছর চাকরি করলেও কোনোদিন অভিযোগ ওঠেনি আমার ছেলের বিরুদ্ধে। কিন্তু সে মামলা দিয়েছে চুরির। আমরা ভাত খেতে পারি না, জামিন করাব কীভাবে। রিপন প্রতিদিন আমাকে হুমকি দেয়।
ছকিনা বেগম জানান, রিপন ও তার ভাই আসিফুর রহমান সুজনের অত্যাচারে ছেলেকে যেখানে চাকরি দিই চাকরি টিকে না। সে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ও চাপ সৃষ্টি করে চাকরিচ্যুত করে। আমার ছেলেকে অন্তত ১০ বার মারধর করেছে রিপন। গ্রাহক ইন্টারনেটের বিল না দিলে সে আমার ছেলের উপর তুলে দেয়। এনজিও থেকে টাকা নিয়ে রিপনকে পরিশোধ করেছি।
জানা গেছে, মো. রিপন আব্দুস সবুর লিটনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। হালিশহর নয়াবাজার, পানিরকল, বউবাজার এলাকার যুবলীগের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাইফুর রহমান পলাশ ও আব্দুস সবুর লিটনের নির্দেশে কিশোর গ্যাং নিয়ে নানা অপরাধ করতেন রিপন।
সম্প্রতি রুমকা আক্তার নামে এক নারী তার বিরুদ্ধে সিএমপিতে অভিযোগ দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, যুবলীগ নেতা রিপন নগরের বিভিন্ন থানায় মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাদের পরিবারের নামেও মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন। তারা চরম হুমকিতে আছেন।
তিন মাস আগে রিপন টাকার বিনিময়ে তার স্বামী সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার করান। এ সময় তাকে ডবলমুরিং থানায় একটি ও তার দেবর সজীবকে ২টি মামলার আসামি করা হয়। তাছাড়াও চান্দগাঁও থানায় একটি মামলায়ও তাদের আসামি করা হয়।
শুধু তাই নয় রুমকা আক্তারের স্বামী সাজ্জাদ জেলে থাকা অবস্থায় নগরের বন্দর থানায় আরো একটি মামলা দেওয়া হয়েছে। রুমকা বন্দর থানায় গেলে তাকে জানানো হয়, হালিশহর থানা থেকে নামগুলো দেওয়া হয়েছে। এসবের পেছনে যুবলীগ নেতা রিপন ও পুলিশের অসাধু লোকজন জড়িত।
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইব্রাহিম সাজ্জাদ কথা বলতে রাজি হননি। এক ভিডিওতে সাজ্জাদের স্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, আধিপত্য নিয়ে তার স্বামীকে একের পর এক মামলায় জড়াচ্ছেন প্যানেল মেয়র লিটনের লোকজন। তার অপরাধ তিনি আলাদা ইন্টারনেট ব্যবসা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাসিন্দা জানান, পুরো এলাকায় ব্যবসা করলে চাঁদা দিতে হতো লিটনকে। আর চাঁদা তুলত পলাশ ও রিপন। তারা দুজন বর্তমানে পলাতক। তাদের কমিউনিকেশন, কারওয়াশসহ কয়েকটি ডিশ-ইন্টারনেট ব্যবসার প্রতিষ্ঠান থাকলেও কোনো নিবন্ধন নেই।
তিনি জানান, ৩, ৪ ও ৫ আগস্ট হালিশহর থেকে আওয়ামী লীগের সবকটি মিটিং ও হামলায় রিপন ছিল লিটনের সঙ্গে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযুক্ত মো. রিপনসহ ডজনখানেক যুবলীগ ক্যাডার বর্তমানে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে লিটনের নির্দেশে তারা সব কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন।
আব্দুস সবুর লিটন জমি দখলে নিতে হালিশহরের বিভিন্ন পরিবারের অভ্যন্তরীণ ঝামেলাগুলো হ্যান্ডেল করতে পছন্দ করতেন। জাহেদুল হক মামুন নামে একজন জানান, ২০২৩ সালের আগস্টে তার পারিবারিক কলহের সুযোগ নিয়ে লিটন হালিশহরের সাবেক ওসিকে দিয়ে তাকে গুমের নাটক সাজান।
পরে তার পরিবারের চাপে রিহ্যাব সেন্টার থেকে তাকে উদ্ধারের নাটক করে। বিভিন্ন সমঝোতার কথা বলে ওসি কায়সারকে দিয়ে ১০ লাখ টাকা আদায় করে। মূলত তাকে ফাঁদে ফেলে সে হালিশহরে এইচ ব্লকে তার বাড়িটা দখল করে নিতে চায়। চেষ্টা করেও সাবেক ওসি মো. কায়সার হামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
এদিকে আব্দুস সবুর লিটন তার অপকর্ম ঢেকে দিতেন নানা কৌশলে। যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলতো তাদের চরিত্র হনন করত কথিত অনলাইন পত্রিকা দিয়ে। সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেল তাকে পত্রিকাটির ডিক্লারেশন নিয়ে দেন।
জানতে চাইলে মো. রিপন সব অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, প্রতিষ্ঠানে চুরির অভিযোগে দণ্ডিত কয়েকজন এসব করেছে। আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। তবে ব্যবসার খাতিরে লিটনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো ছিল।
চেষ্টা করেও হালিশহরের সাবেক ওসি মো. কায়সার হামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
জানতে চাইলে হালিশহর থানার ওসি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, আমার এ বিষয়ে কিছু জানা নেই। তাছাড়াও সাবেক প্যানেল মেয়র লিটনকেও আমি চিনি না।