
ছিলেন একজন সরকারি চিকিৎসক। ৩৮তম বিসিএসে ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ পান। দেশের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ছিলেন নিষ্ঠা আর পেশাদারত্ব নিয়ে। কিন্তু হঠাৎ করেই এক রাতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন সরকারি কোয়ার্টার থেকে। কোনো অভিযোগ নেই, তবুও তুলে নিয়ে গেল সাদা পোশাকধারীরা। এরপর শুরু হয় জীবনের ভয়াবহ এক অধ্যায়। গুম, মানসিক নির্যাতন, মামলা আর বরখাস্ত। ডা. মো. জাকির হোসেনের এই অভিজ্ঞতাকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের এক নিখুঁত ছক হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
অন্যদিকে একই ছকে গুম হন আরেক বিসিএস ক্যাডার, কলেজ শিক্ষক মো. মোতাহার হোসেন। ৩৩তম বিসিএসের এই প্রভাষককে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে যায় মুখোশধারী র্যাব সদস্যরা। গুমখানায় চারদিন কাটানোর পর তাকেও জড়ানো হয় নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে।
দেশের স্বাস্থ্য খাতে নিয়োজিত ছিলেন ডা. মো. জাকির হোসেন। তার নিখোঁজের পর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে তার পরিবার। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমও ছিল সরব। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতা ক্রমেই গভীরতর রহস্যের জন্ম দেয়। এরপর আসে মিথ্যা মামলা, সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত এবং এক চিকিৎসকের জীবন ও ক্যারিয়ারের নির্মম পরিণতি। স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা ডা. জাকির তার নির্মম অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন আমার দেশ-এর কাছে।
ডা. জাকির জানান, ২০২২ সালের ৮ নভেম্বর রাত আনুমানিক ৯টায় ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোয়ার্টার থেকে তাকে তুলে নেয় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরা। তার মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়া হয়, পাসওয়ার্ড আদায় করে মোবাইল থেকেই তার পরিবারের সদস্য ও অফিসপ্রধানকে পাঠানো হয় বিভ্রান্তিকর মেসেজ— যেন তিনি স্বেচ্ছায় কোথাও গেছেন। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর মিন্টু রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে, যেখানে তাকে রাখা হয় অজ্ঞাত একটি গোপন বন্দিশালায়।
সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে জাকির হোসেন বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল, পরদিন ছেড়ে দেবে। বলবে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে আমি আত্মগোপনে ছিলাম। কিন্তু সত্যি হলো— আমি গুম হয়েছিলাম। এরপর মিথ্যা মামলা, চাকরিচ্যুতি আর ভেঙে যাওয়া জীবন।’ তিনি বলেন, ‘গুমে থাকার সময়ে আমাকে বলা হয়, আমি নাকি অনলাইনে সরকারের বিরুদ্ধে লেখালেখি করি। অথচ এটা ছিল প্রমাণহীন একটা মিথ্যা অভিযোগ।’
গুমের পর তার স্ত্রী থানায় জিডি করেছিলেন। দেশের শীর্ষ বিভিন্ন গণমাধ্যমে একের পর এক প্রকাশিত হয় ‘নিখোঁজ চিকিৎসক’ সংক্রান্ত নানা প্রতিবেদন।
গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার কয়েক দিন পর, ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এজাহারে বলা হয়— তাকে নাকি ওইদিন যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যেখানে সে ‘নাশকতার পরিকল্পনা’ করছিল এবং মোবাইল ফোনে রাষ্ট্রবিরোধী ব্লগে লগ ইন করা ছিল। অথচ ৮ নভেম্বর থেকে তার মোবাইল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ছিল, বন্ধ অবস্থায়। এমনকি মামলা দায়েরের আগের রাতে আবারো পাসওয়ার্ড নিয়ে মোবাইল থেকে ভুয়া স্ক্রিনশট নেওয়ার অভিযোগও তিনি করেছেন।
গ্রেপ্তারের পর টানা ছয় মাস কারাগারে থাকতে হয় ডা. জাকিরকে। এখন জামিনে মুক্ত হলেও মামলার চার্জশিট আজও হয়নি। অথচ এই মিথ্যা মামলার ভিত্তিতে তাকে বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর প্রভাবে তিনি এফসিপিএস পার্ট ১ ও এমআরসিপি পার্ট ২ পাস করেও উচ্চতর চিকিৎসা প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারছেন না।
ডা. জাকির বলেন, গুম অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলে মানসিক নির্যাতন। আমার সব স্বপ্ন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে রাষ্ট্রযন্ত্রের অদৃশ্য চাপে।
স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ানোই কাল হয়
ডা. মো. জাকির হোসেন জানান, ‘গুম ও মামলার ঘটনার কিছুদিন আগে একটি মেডিকেল সার্টিফিকেট ইস্যু নিয়ে স্থানীয় পুলিশের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা হয়। এ ঘটনার জের ধরেই তাকে টার্গেট করা হতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি।’
জাকির হোসেন আরো বলেন, ‘আমি কোনো নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমি ২ দফায় পুলিশ ভেরিফিকেশনে উত্তীর্ণ হয়েই দুবার আমি বিসিএস (৩৮ ও ৩৯) ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। আমি কোনো ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী কাজে যুক্ত থাকলে এমনটা নিশ্চয়ই হতো না।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি চাই রাষ্ট্র গুমের ঘটনার সঠিক তদন্ত করুক, ভুক্তভোগীদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করুক, তাদের পরিবারের নিরাপত্তা দিক এবং গুমের কারণে যারা চাকরি হারিয়েছেন তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করুক।’
কলেজ শিক্ষক গুম
৩৩তম বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন ছিলেন নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজের প্রভাষক। কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। অথচ তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল নিষিদ্ধ সংগঠন ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সঙ্গে।
গত বছরের ১৪ অক্টোবর মোতাহার হোসেন ‘গুম-সংক্রান্ত কমিশন অফ ইনকোয়ারি’-এর কাছে একটি লিখিত আবেদন করেন। অভিযোগে মোতাহার হোসেন বলেন, ‘২০২০ সালের ১৫ মার্চ আমাকে গাজীপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে র্যাব-৪ এর সদস্যরা জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায় এবং চারদিন গুম করে রাখে। পরে মিথ্যা মামলায় ১৫ মাসের বেশি সময় জেল খাটতে হয়। অথচ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ১৯ মার্চ ঢাকার দারুস সালাম এলাকা থেকে। এই পুরো ঘটনা সাজানো, বানোয়াট ও অমানবিক।’
এই বিভ্রান্তি আদালতে উপস্থাপন করা হলে বিচারক মামলার অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতি, মিথ্যা গ্রেপ্তার স্থান এবং অভিযোগের দুর্বলতা বিবেচনা করে ২০২২ সালের ২৫ জুলাই চার্জ গঠনের সময় মামলাটি বাতিল করে দেন।
মোতাহার হোসেন জানান, চারদিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন অন্ধকারে। শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নিপীড়ন আর সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক গুমখানায় থাকতে হয়েছে। চোখ-মুখ বেঁধে তাকে রাখা হয় একটি অজ্ঞাত স্থানে।
এ সময় আক্ষেপ জানিয়ে মোতাহার বলেন, ‘একজন সরকারি কর্মকর্তা যদি রক্ষা না পায়, তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়?’
গুমের ঘটনার কোনো তদন্ত হয়নি
মোতাহার হোসেন এই ঘটনার আইনগত প্রতিকার চেয়ে ‘গুম সংক্রান্ত কমিশন অফ ইনকোয়ারি’-তে একটি বিস্তারিত আবেদনপত্র জমা দেন। সেখানে অভিযুক্তদের নাম, পদবি, ফোন নম্বর ও ঘটনার বিবরণ সংযুক্ত করেন। এতে মো. আকতারুজ্জামান (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, র্যাব-৪), উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মাসুদ রানা, উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মো. আবিদ উর রেজা, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) তপন কুমার দাস, এএসআই ফয়সাল আলম, এএসআই কুতুবুল আলমসহ মোট ১০ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। তবে এই গুমের ঘটনায় এখনো কোনো তদন্ত হয়নি।
২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় র্যাবের মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই ধরনের অপরাধ আমলে নিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে র্যাবের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আছে, সেগুলোর বিচার হবে।’
র্যাব সৃষ্টির পর থেকে যেসব জনসাধারণ র্যাব সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত, অত্যাচারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পরিবারের কাছে দুঃখপ্রকাশ এবং ক্ষমা প্রার্থনাও করেছিলেন তিনি।
দুই বিসিএস ক্যাডারের গুম প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহরিয়ার মাহমুদ বলেন, ‘একজন নিরপরাধ সরকারি কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুমের পর ১৫ মাসের বেশি সময় কারাগারে আটকে রাখা কেবল ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক ও পেশাগতভাবেও তার জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। জামিনে মুক্তির পরও তিনি আর তার কর্মজীবনে ফিরতে পারেননি।’
শাহরিয়ার মাহমুদ আরো বলেন, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের ঘটনা— গুম, নির্যাতন ও ভুয়া মামলার মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো, নির্বিচারে আইনের অপপ্রয়োগ এবং গণতন্ত্রের ওপর সরাসরি আঘাত। সন্ত্রাসবিরোধী আইনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের এ উদাহরণ শুধু মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়, বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট করছে।’