Image description

সৈয়দ আবদাল আহমদ

 

আজ ১ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৭৮ সালের এ দিনে রাজধানী ঢাকার রমনায় এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাধীনতার মহান ঘোষক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে’র নতুন এক দর্শন উপস্থাপন করে ১৯ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই দল গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি আজ ৪৭ বছর পূর্ণ করল।

রাজনীতিতে বিএনপি বিকশিত হয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বড় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। না, শুধু বড় রাজনৈতিক দলই নয়—বিএনপির নেতৃত্বে দেশে অন্তত পাঁচটি সরকার গঠিত হয়েছে এবং দেশের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে বিএনপি সরকারের আমলে। এ দলের হাতেই দেশের অর্থনীতির ভিত তৈরি হয়। আবার দলটি বারবার বিপর্যয়ের মুখেও পড়েছে।

বর্তমানে বিএনপির প্রায় চার যুগ পূর্তি এমন এক সময়ে উপস্থিত, যখন শেখ হাসিনার দীর্ঘ পনেরো বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর দেশ গণতান্ত্রিক উত্তরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে মুক্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতিহাসসেরা একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে। কারণ ফ্যাসিবাদী আমলে দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ফলে একটি সুন্দর নির্বাচন এখন সবার প্রত্যাশা।

গত ১৫ বছরে বিএনপি বড় ধরনের বিপর্যয়ই শুধু মোকাবিলা করেনি, এ দলের অগণিত নেতাকর্মী জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। দলটির ৬০ লাখ নেতাকর্মী ছিলেন মামলার আসামি। এছাড়া ইলিয়াস আলীসহ অসংখ্য নেতাকর্মী গুম ও খুনের শিকার হয়েছেন। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বিএনপি এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দলটির সামনে এখন নির্বাচনি লড়াই। হয়তো সেদিন বেশি দূরে নয়, আগের মতোই জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বিএনপি আবার দেশ সেবায় নিয়োজিত হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন জনরায়ে তার দল বিজয়ী হলে জাতীয় সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করবেন তিনি । রাষ্ট্র সংস্কারে দলের পক্ষ থেকে ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে।

 

বিএনপি প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ যখন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নিপীড়ন, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, দুর্ভিক্ষ ও একদলীয় শাসনের নাগপাশে বন্দি, যখন দেশে স্বাধীন সংবাদপত্র ও বিচারব্যবস্থা একদলীয় শাসনের অক্টোপাশে আবদ্ধ, অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যে দেশের সামগ্রিক অবস্থা যখন বিপর্যস্ত এবং স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন, ঠিক তখন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন বীর উত্তম জিয়াউর রহমান । অবশ্য এর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার দুঃখজনক ঘটনা। এ পরিস্থিতিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদ দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশে প্রথম সামরিক শাসন জারি করেন। কিন্তু পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান দায়িত্বে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মে দিবসের এক শ্রমিক সমাবেশে ঘোষণা করেন—‘সামরিক শাসন কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না।’ তিনি সামরিক শাসন অবসানের উদ্যোগই শুধু নেননি, দেশকে গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে বহুদলীয় রাজনীতি চালুর ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদ বসার আগেই দেশ থেকে সামরিক আইন তুলে নেয়া হয়েছিল।

 

এই সময় দেশ ও জাতির ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই নতুন রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। বাকশাল গঠন, সংবাদপত্র ও মৌলিক অধিকার হরণ, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন এবং হিংসাশ্রয়ী রাজনীতির ফলে দেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা পূরণের জন্য এবং স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনীতি চালু করে দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই দল প্রতিষ্ঠা করা তখন ছিল অপরিহার্য।

 

দেশের শাসনভার গ্রহণ করার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশবাসীর মুক্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। সমস্যাসঙ্কুল বাংলাদেশের উন্নতির জন্য প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি ও পদক্ষেপ। এটা উপলব্ধি করেই ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান জাতির সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে ঘোষণা করেন ১৯ দফা কর্মসূচি। একই বছর ৩০ মে আস্থাসূচক গণভোটে জাতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব ও ১৯ দফার প্রতি আস্থা জানায়। এই ১৯ দফাভিত্তিক জাতি গঠনের সংগ্রামে দেশবাসী সম্পৃক্ত হন। বিভিন্ন সমমনা রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ফ্রন্ট মনোনীত জিয়াউর রহমান জনগণের সরাসরি ভোটে দেশের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন। বিজয় সূচিত হয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির; শুরু হয় ইতিহাসের নতুন অধ্যায়।

 

এরপর জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে গঠন করেন এই বিএনপি। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনে ৫ মাস ১৮ দিনে প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ১৫২টি আসনে জয়লাভ করে। দেশবাসী বিএনপির পক্ষে শান্তি, উন্নতি ও প্রগতির পক্ষে রায় দেয়। ওই সংসদে বিএনপির বিজয়ই শুধু নয়, প্রেসিডেন্ট জিয়া চাচ্ছিলেন অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা যাতে সংসদে পাস করে আসতে পারেন। যেমন— সবুর খান, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আসাদুজ্জামান খান, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, মহিউদ্দিন আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, আতাউর রহমান খান। জিয়া চেয়েছিলেন একটি শক্তিশালী প্রাণবন্ত সংসদ এবং সেই সংসদই ১৯৭৯ সালে গঠিত হয়েছিল। সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগের আসাদুজ্জামান খান। এভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে, সংসদকে গুরুত্ব দিয়ে, দেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে, উৎপাদনের রাজনীতিতে গণঐক্য সৃষ্টি করে এবং সরকার ও জনগণকে একাত্ম করে জিয়া প্রতিষ্ঠিত বিএনপি প্রমাণ করে—ক্ষমতা অর্জনের জন্য রাজনীতি নয়, রাজনীতির উদ্দেশ্য গণমানুষের ভাগ্য পরিবর্তন।

 

জিয়াউর রহমানের দেশকে জাগিয়ে তোলা

দল গঠনের পর এ দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উৎপাদনের রাজনীতি ও সৃজনশীল উদ্যোগ নিয়ে জাতিকে জাগিয়ে তোলার দিকনির্দেশনা দিলেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ বিএনপি উৎপাদনমুখী রাজনীতির যে সূচনা করেছে, তার সাক্ষী আজকের বাংলাদেশ। ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠার পরপরই দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক শান্তি ফিরে আসে। প্রতিষ্ঠিত হয় বহুদলীয় গণতন্ত্র। নিশ্চিত হয় সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। গণতান্ত্রিক পরিবেশে দেশের সব রাজনৈতিক দল তাদের রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পায়। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ মুছে যায়। গ্রামমুখী উন্নয়ন শুরুর ফলে বাংলাদেশের গ্রামীণ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলা অবস্থার উন্নতি ঘটে। গ্রামসরকার, গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ও কুটিরশিল্প স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামের উন্নয়ন ও গ্রামীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। বিএনপি সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা, শিক্ষার প্রসার, চিকিৎসা নিশ্চিত করা, খালকাটা কর্মসূচির মাধ্যমে সেচ সমস্যার সমাধান ইত্যাদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি ও পোশাকশিল্প স্থাপনের যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন জিয়াউর রহমান। এর ফলে দেশের উৎপাদন বেড়ে যায় দ্বিগুণ এবং দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিদেশে চাল রপ্তানি হয়।

 

সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান, একটি সার্বভৌম সংসদ অর্জন, মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন, উৎপাদনমুখী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি চালু, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি চালু, সংবাদপত্র, বাক-ব্যক্তির স্বাধীনতা ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার চালু, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, কৃষি বিপ্লব, নারী উন্নয়ন এবং জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি বিএনপি সরকারের ওই সময়ের বড় সাফল্য। ওই সময় স্মরণকালের খরার ফলে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করা এবং স্বনির্ভর আন্দোলনেরও সূচনা করেছিল বিএনপি দলীয় সরকার। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভ, ওআইসির সদস্যপদ লাভ, ইরান-ইরাক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতার জন্য আল কুদস কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হওয়া, দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক গঠনে উদ্যোগ ছিল জিয়াউর রহমান ও প্রথম বিএনপি সরকারের অন্যতম সাফল্য। কিন্তু নব্য স্বাধীন বাংলাদেশ ও তার স্বাধীনতাপ্রিয়

 

জিয়ার অগ্রযাত্রা থামাতে কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্র

জনগণের প্রত্যয়ী ঐক্য এবং অব্যাহত বিজয়ে শঙ্কিত আধিপত্যবাদী শক্তি ও তাদের দোসরদের চোখে এই অগ্রযাত্রা সহ্য হয়নি। তাই তারা পর্দার অন্তরালে শুরু করে চক্রান্ত। সে চক্রান্তের ফলেই ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল বিপথগামী সেনার হাতে শাহাদতবরণ করেন জিয়া। ঘাতকের বুলেটের আওয়াজ থামতে না থামতেই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল সারা দেশ। প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীরা তখন বাধ্য হয়েছিল আত্মগোপন করতে। প্রত্যক্ষ অপরাধীদের চক্রান্ত গণরোষে দগ্ধ হয়ে গেলেও সেই চক্রান্তকারীরা সাময়িকভাবে পর্দার অন্তরালে চলে যায়। কিন্তু চক্রান্ত চলতে থাকে। দেশে সেদিন সামরিক শাসন জারি হয়নি প্রবল জনরোষের ভয়ে। দেশে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচনও হয়। বিএনপি মনোনীত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তার এক কোটিরও বেশি ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। কিন্তু শহীদ জিয়াকে হত্যার মাধ্যমে যে চক্রান্তের শুরু, তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ। সংবিধান স্থগিত করা হয়, সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। পুনরায় হত্যা করা হয় গণতন্ত্র। জিয়ার শাহাদতের বিপর্যয় কাটতে না কাটতেই বিএনপি আরেক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। মিথ্যা মামলা, জেল-জুলুম-হয়রানি নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।

 

রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার বর্ণাঢ্য অধ্যায়

বিএনপির এই বিপর্যয়ের মুখে নেতাকর্মী-শুভাকাঙ্ক্ষী ও দেশের মানুষের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অবশেষে বিএনপির রাজনীতিতে পদার্পণ করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া। সেদিন ছিল ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি। বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হওয়ার মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তখন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। পরে দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিতও হন তিনি এবং বেগম খালেদা জিয়াকে করা হয় দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। এরই মধ্যে দেশে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। বেগম জিয়া এ আন্দোলনে এগিয়ে আসেন।

 

বিএনপি চেয়ারম্যান বিচারপতি সাত্তার শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ও পরে নির্বাচিত হয়ে দলের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সক্রিয় রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার পদার্পণ এবং সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার খবরে ভীত হন এরশাদ। কিন্তু ভীত হয়েই থেমে থাকেননি কুচক্রী জেনারেল তিনি শুরু করেন নানা ষড়যন্ত্র। বিএনপির কিছু নেতার সঙ্গে আঁতাত করে শুরু হয় একের পর এক বিএনপি ভাঙার অপচেষ্টা। প্রথমেই হুদা-মতিন গ্রুপ বিএনপি থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর এক এক করে অনেক নেতাকে মন্ত্রিত্ব ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ভাগিয়ে নেন এরশাদ। এভাবে তিনি বিএনপিকে পঙ্গু করে দেওয়ার অপচেষ্টা চালান। একপর্যায়ে দলের মহাসচিব কেএম ওবায়দুর রহমানকেও ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন এরশাদ। কিন্তু আগেই খবরটি পেয়ে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

 

এভাবে শত বিপর্যয়ের মুখেও টলেনি বিএনপি, টলানো যায়নি বেগম জিয়াকে। গঠিত হয় ৭ দলীয় ঐক্যজোট। শুরু হয় দুর্বার এরশাদবিরোধী গণআন্দোলন। একপর্যায়ে অন্য দল ও জোট নির্বাচনে গেলেও যাননি শুধু বেগম জিয়া এবং তার ৭ দলীয় ঐক্যজোট। তিনি আপসহীন নেত্রী খেতাবে ভূষিত হন। অন্যান্য দল ও জোটকে যুগপৎ আন্দোলনে বাধ্য করেন। এভাবে দীর্ঘ ৯ বছরের আন্দোলনের পর এরশাদের পতন হয়। জিয়াউর রহমানের মৃত্যু এবং পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ ৯ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল বিএনপি। তবে এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনেই অংশ নেয়নি বিএনপি।

 

১৯৯০ সালে এরশাদ স্বৈরাচারের পতনের পর ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে অসামান্য সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে সব পূর্বাভাস ভুল প্রমাণ করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি।

 

সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে পঞ্চম সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ বিএনপি সরকার গঠিত হয়। তার আগের সময়টুকু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থায় খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন এবং দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে স্বল্প সময়ের জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তবে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিএনপি হেরে গেলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সর্বশেষ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর এক অবিস্মরণীয় বিজয়ের মাধ্যমে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিজয়ী হয়ে আবার সরকার গঠনের সুযোগ পায়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তার যোগ্য উত্তরসূরি বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির হাল ধরে দলটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সাফল্যের সঙ্গে। এক সময় বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলা হতো। কিন্তু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশের প্রতিটি থানা-উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও বিএনপির শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি হয়।

 

নতুন নেতা তারেক রহমান

২০০২ সালে বিএনপির প্রথম যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করে তারেক রহমান দলকে নতুন উদ্যমে সাজানোর ও সংগঠিত করার কার্যক্রম শুরু করেন। প্রথমেই বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে তিনি দৃষ্টি কাড়েন দলের তৃণমূল নেতাদের। এরপর সারা দেশে তৃণমূল নেতাদের সম্মেলনের আয়োজন করেন। কিন্তু তারেক রহমান রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হন—এটি চায়নি দেশি-বিদেশি একটি মহল। ফলে তাকে বিতর্কিত করার জন্য শুরু হয় নানামুখী ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা অপপ্রচার। ভারতীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১/১১’র জরুরি সরকার ক্ষমতায় আসে। খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হতে পারেনি খালেদা জিয়ার আপসহীন ভূমিকার কারণে।

 

ওই সময় তারেক রহমানকে প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে শেষ করে দেওয়ারও চক্রান্ত হয়েছিল। জরুরি আইনের অবসান ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয়। খালেদা জিয়া ১/১১’র কারাগার থেকে মুক্ত হন। তবে তারেক রহমানকে বিদেশে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হতে হয়। ২০০৮ সালের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে টানা পনেরো বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকেন। খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে জেলে নেওয়া হয় ২০১৮ সালে । লন্ডন থেকে তারেক রহমান দলের হাল ধরেন। তিনিই এখন বিএনপি এবং জাতীয়তাবাদীর শক্তির প্রাণভোমরা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি এখন ঐক্যবদ্ধ এবং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। খালেদা জিয়া পুরোপুরি সুস্থ নন। তবে দলে চেয়ারপারসন হিসেবে তিনি প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন দলের নেতৃত্বকে।

 

বিএনপির ৪৭ বছরে এ দলের চেয়ারপাররন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বিচারপতি আবদুস সাত্তার, বেগম খালেদা জিয়া ও বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কর্নেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান, কেএম ওবায়দুর রহমান, ব্যারিস্টার আবদুস সালাম তালুকদার, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও বর্তমানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য দল থেকে বহিষ্কৃত হন দু’জন মহাসচিব। এরা হলেন কেএম ওবায়দুর রহমান ও আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। জরুরি সরকারের সময় ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর বহিষ্কৃত হন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া।

বিএনপির অগণিত নেতাকর্মী এখন তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় আছেন। দল থেকে জানানো হয়েছে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি দেশে ফিরছেন। ১৭ বছরের নির্বাসনের পর তারেক রহমান দেশে আসছেন এবং তার নেতৃত্বেই বিএনপির ৩০০ প্রার্থী নিজ নিজ আসনে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন।

 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমার দেশ