
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামের দীর্ঘ ধারা রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় অনেক তরুণ দেশ ও মানুষের অধিকারের জন্য জীবন দিয়েছেন। শহীদ শাকিল পারভেজ ছিলেন তাদেরই একজন, যিনি ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালে উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার সময় পুলিশের গুলি সরাসরি তার বুকে গালে। পরক্ষণে শহীদ শাকিল পারভেজ মাটিতে লুটে পড়েন। সহযোদ্ধা উদ্ধার করে হসপিটালে নিলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।
শাকিল পারভেজ: এক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ
শাকিল পারভেজ ছিলেন মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষার্থী। তিনি টঙ্গী সরকারি কলেজে ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত ছিলেন এবং পাশাপাশি মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ছিলেন। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় তা'মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা, টঙ্গী থেকে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ন্যায়বিচার ও মানবতার আদর্শে বেড়ে ওঠেন। তার সহপাঠীরা বলেন, শাকিল ছিলেন স্পষ্টভাষী, প্রতিবাদী এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতা সম্পন্ন একজন তরুণ।
একজন বাবার ঈদ—চোখের জলে ভাসা দিন
শহীদ শাকিলের বাবা বেলায়েত হোসেন বলেন, এবার ঈদ কেটেছে চোখের পানিতে। কলিজার টুকরো শাকিল ছাড়া ঈদ আনন্দ আসে কিভাবে? ঈদের সকাল থেকে এলাকার মানুষ শোক জানাতে তাদের বাসায় আসছিল, কিন্তু এই অভাব পূরণ হওয়ার নয়। তিনি আরও বলেন, শাকিলের মা প্রতিনিয়ত তার কাপড় জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, তার ছবি দেখে আহাজারি করছে।
শাকিলের সাথে ঈদের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, প্রতিবছর ঈদের সকালে শাকিল আমার পায়ের আঙুল টিপে টিপে ঘুম থেকে তুলত। তারপর হাসিমুখে বলত— বাবা, ২০ টাকা ঈদ সালামি দেন। আজ সেই ডাক আর শোনা যাবে না।
শহীদ সাকিল পারভেজের সহপাঠী রাকিব হোসাইন বাপ্পী জানান, প্রতিবারের মতো এবার আর শাকিলের ঈদের শুভেচ্ছা মেসেজ আসবে না, সেটা জানতাম। তবুও ঈদের সকালে তার পুরোনো মেসেজগুলো স্ক্রল করছিলাম, তার প্রোফাইলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। প্রতিটি স্মৃতি একে একে ভেসে উঠছিল। এই তো, আজকের দিনেই নামাজ শেষে দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তুলতাম, আপলোড দিতাম।
এবারের ঈদ হয়তো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ঈদ ছিল, তবু প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে অপূর্ণতায়। শাকিল ও তার মতো আরও অনেক শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি। আমি চাই, পরবর্তী ঈদের আগে খুনিদের বিচার নিশ্চিত হবে, আর দেশের মানুষ সত্যিকারের আনন্দ নিয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারবে।
শাকিলের মায়ের চিকিৎসা নিয়ে উদ্বেগ
শাকিলের বাবা জানান, শোকের ভারে তার অসুস্থ স্ত্রী পারভিন আক্তার আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কিন্তুু আমি এখনো দেশের অবস্থা দেখে ভয় পাচ্ছি। শাকিল দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, কিন্তু এখন তার মায়ের চিকিৎসার নিরাপত্তা কতোটুকু পাবো? সাংবাদিক ও সরকারের সহযোগিতা চাই, যাতে শাকিলের মায়ের সঠিক নিরাপদ চিকিৎসা নিশ্চিত হয়।
শেষ মুহূর্তের ফুটেজ দেখার আকুতি
শাকিলের বাবা চান, মৃত্যুর মুহূর্তের ফুটেজ প্রকাশ করা হোক, যাতে বোঝা যায় তার ছেলে শেষ সময়ে কাকে স্মরণ করেছিল, কী বলেছিল। তিনি বলেন, আমি দেখতে চাই, আমার সন্তান শেষ মুহূর্তে কী অবস্থায় ছিল। মৃত্যুর আগে সে কি তার মাকে ডাকছিল, নাকি আমায়? আমি চাই, তার বীরত্বের মুহূর্তের ফুটেজ প্রকাশ করা হোক। তাহলে অন্তত কিছুটা শান্তি পাবো।
শহীদ শাকিলের বাবা বেলায়েত হোসেন
প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের নিঃশেষন
শাকিলের বাবা বলেন, আমি সবসময় শাকিলকে বলতাম— বিড়ালের মতো ১০০ বছর বেঁচে থাকার চেয়ে সিংহের মতো ১ ঘণ্টা বেঁচে থাকাই ভালো, যদি তা ন্যায়ের জন্য হয়।
শাকিলের মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়, গণতন্ত্র ও অধিকারের দাবিতে কত তরুণ প্রাণ ঝরে যায়। সহপাঠীরা বলছেন, শাকিল শুধু একজন ছাত্রনেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।
এই মৃত্যু কি শুধুই একটি সংখ্যা হয়ে থাকবে, নাকি শাকিলের আত্মত্যাগ আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে? ন্যায়বিচারের দাবিতে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে, যাতে এমন আর কোনো শাকিলকে অকালে ঝরে যেতে না হয়।