
মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর আনন্দ ও উৎসবের। এই দিনে শিশুদের নতুন পোশাকে ছুটে বেড়ানোর কথা, হাসির উচ্ছ্বাসে মুখরিত হওয়ার কথা, বয়স্কদের কাছ থেকে ঈদ সালামি নেওয়ার কথা এবং আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার কথা। বাড়ি ভরে থাকার কথা সুগন্ধি মিষ্টান্ন—মামুল, কা’ক, আর ঈদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের সুবাসে।
কিন্তু গাজায় এবারের ঈদ শোকের। বাতাস ধুলোয় আচ্ছন্ন, ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ভেসে আসছে চাপা কান্না। বিস্ফোরণের শব্দ যেন থামছেই না। ঈদের মিলনমেলা এবার বদলে গেছে শোকে—পরিবারগুলো এখন কেবল ধ্বংসস্তূপের মাঝে বসে প্রিয়জনদের স্মরণ করছে।
লেখক শাহদ আলনামি তার লেখায় বলেছেন, আমরা অনেকেই অনাহারে মরার মুখে, জীবনের শেষ আশাটুকু আঁকড়ে ধরে আছি, প্রতিটি মুহূর্তে ভাবছি—পরবর্তী বোমাটি আমাদের ওপরই পড়বে কি না।
এ ছাড়া শাহদ আলনামি সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় তার লেখার মাধ্যমে গত বছরের শেষের দিকে ইসরায়েলের বর্বর হামলায় নিহত তার ছোট বোনের জন্য শোক প্রকাশ করেছেন। বোনের সঙ্গে কাটানো ১৩টি ঈদের স্মৃতিচারণ করেছেন।
আমার বোন ছাড়া আমার প্রথম ঈদ
এটাই হবে আমার প্রথম ঈদ, যেখানে আমার ছোট বোন রাহাফ নেই। সে শুধু আমার বোনই ছিল না, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুও ছিল। এই যুদ্ধের সময় আমরা একে অপরকে আঁকড়ে ধরে ছিলাম, একে অপরের মাঝে স্বস্তি খুঁজেছি।
আমরা একসঙ্গে ১৩টি ঈদ কাটিয়েছি। প্রতিটি ঈদেই রাহাফ ছিল আমাদের আনন্দের উৎস। হাঁটতে শেখার পর থেকেই সে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে সারা বাড়ি ছুটে বেড়াত, চিৎকার করে জানিয়ে দিত ঈদ শুরু হয়ে গেছে!
সে নতুন পোশাক পরে আমাকে বলত তার চুল ঠিক করে দিতে। এরপর আমরা দাদু-নানুর বাড়িতে যেতাম, পরিবারের সঙ্গে বসে চা খেতাম, মায়েদের বানানো মিষ্টি খেতাম। কিন্তু এবার কিছুই নেই। না আছে ঈদের প্রস্তুতি, না আছে কোথাও যাওয়ার জায়গা। আর নেই রাহাফ।
আমি কখনও ভাবিনি তাকে হারাব। আমাদের স্বপ্ন ছিল সবসময় একসঙ্গে থাকার, জীবনের প্রতিটি সাফল্য একসঙ্গে উদযাপনের।
সে চেয়েছিল বড় হয়ে একজন চিত্রশিল্পী হবে। আমি চেয়েছিলাম তার আঁকা ছবি দেখে গর্বিত হব, বিশ্ব একদিন তার প্রতিভা চিনবে।
আমার স্বপ্ন ছিল একদিন আমার প্রথম বই প্রকাশ হবে, আর আমরা একসঙ্গে সেটা উদযাপন করব। কিন্তু আজ সে নেই।
সেই রাত যেদিন রাহাফ চলে গেল
২৮ ডিসেম্বর ভোররাতে আমাদের বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম, যখন রাত ৪টায় পাশে আমার চাচার বাড়িতে বোমা পড়ে। সেই বিস্ফোরণে আমাদের বাড়িও গুঁড়িয়ে যায়।
রাহাফ আমার চাচার বাড়ির পাশের ঘরে ঘুমিয়েছিল। সে সেখানে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। অথচ সেই ঘরটি ছিল আমার! মাত্র চার দিন আগে আমরা জায়গা বদল করেছিলাম। যদি তা না করতাম, তাহলে হয়তো আজ আমি তার জায়গায় থাকতাম।
সেদিনের পর থেকে শোক করার সময় নেই। কষ্ট বুকে চেপে রাখতে হয়, কারণ এখানে দুঃখ করাও বিলাসিতা।
যুদ্ধের মাঝে শোক থামানো যায় না। যেকোনো মুহূর্তে আরও প্রিয়জন চলে যেতে পারে।
একটি শিশুর প্রশ্ন, যার উত্তর আমার জানা নেই
আমার সাত বছর বয়সী কাজিন ক্বামার একদিন আমার কাছে এসে বসেছিল। সে এক মুহূর্ত চিন্তা করে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “শাহদ, তুমি তোমার বাড়িতে নেই কেন? তোমার বাড়ি গেল কোথায়?”
তার সহজ অথচ বেদনাদায়ক প্রশ্ন আমাকে স্তব্ধ করে দিল। আমি নিঃশ্বাস নিলাম। “আমাদের বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, বোমা মেরে শেষ করে দিয়েছে। আমাদের সবকিছু হারিয়ে গেছে—দেওয়াল, স্মৃতি… আর রাহাফও।”
সে বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, “আর রাহাফ? সে কোথায়?” আমার গলা শুকিয়ে গেল। ক্বামার জানত রাহাফ নেই, তবুও তার প্রশ্ন আমাকে বিদ্ধ করল।

আমি ধীরে ধীরে বললাম, “রাহাফ এখন স্বর্গে। যুদ্ধ তাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে, আমরা তাকে আর ফেরত আনতে পারব না।”
তার ছোট্ট চোখে দ্বিধা আর কষ্টের ছায়া পড়ল। “কিন্তু কেন তাকে যেতে হলো? ওকে কেন নিয়ে গেল?”
আমি ক্বামারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। “আমি জানি না, ক্বামার। আমি যদি তোমাকে বোঝাতে পারতাম।”
সে ফিসফিস করে বলল, “আমি আবার রাহাফকে দেখতে চাই। আমি ওকে মিস করি।”
আমার চোখে পানি এসে গেল। “আমি ওকে প্রতিদিন মিস করি। কিন্তু সে আমাদের হৃদয়ে থাকবে, সবসময়।”
আমি ভাবতে লাগলাম—একদিন ক্বামার বুঝতে পারবে যুদ্ধ কেবল ভূমি ধ্বংস করে না, এটি মানুষের জীবনও গুঁড়িয়ে দেয়।
কতদিন লাগবে তার বুঝতে যে যুদ্ধের ক্ষত সহজে মুছে না? কিন্তু আমি চাই না সে এসব বোঝুক। সে এখনও ছোট। তার মনে এই দুঃখ থাকার কথা নয়।
আমি যদি পারতাম, গাজার সব শিশুকে আমার হৃদয়ে লুকিয়ে রাখতাম, তাদের এই ভয় আর দুঃখ থেকে রক্ষা করতাম।
যুদ্ধের মাঝে বেঁচে থাকা, শোকের সময় না পাওয়া
পৃথিবী চায় আমরা শক্ত থাকি, কিন্তু যুদ্ধ আর শোক আমাদের সব শক্তি শুষে নিচ্ছে। একটি চলমান গণহত্যার মাঝে বেঁচে থাকার লড়াই করতে করতে শোক করাও অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
তবু আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষদের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকি। তারা আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকে, আমাদের কথায়, আমাদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে।
আশা, যতই ক্ষীণ হোক, সেটাও প্রতিরোধের একটি রূপ। এটি আমাদের শেখায় ধ্বংসস্তূপের মাঝেও আলো খুঁজতে, শূন্যতার মাঝে অর্থ খুঁজতে, শুধু টিকে থাকাকে নয়, জীবনকে খুঁজতে।
এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আমরা এখনও বেঁচে আছি এবং সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।