চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতিতে বইছে একের পর এক পরিবর্তনের হাওয়া। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শেখ হাসিনার সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে আওয়ামী লীগ। ৫ আগস্টের পর দেশের ইসলামিক দলগুলোর মধ্যে যে ভোটের সমঝোতা হয়েছে, তার বড়ো প্রভাব পরতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে। গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন বন্দোবস্তের নামে বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের একটি অংশের মাধ্যমে তৈরি হওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন যত কাছে আসছে ততই গুরুত্ব বাড়ছে এনসিপির। গত কয়েকদিন আলোচনা হচ্ছে কোন দলের সঙ্গে নির্বাচনি জোট করতে যাচ্ছে দলটি? বিষয়টি এখনও পর্যন্ত আলোচনার মধ্যেই রয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর রাতে এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় আলোচনা হয় নির্বাচন নিয়ে। যেখানে দলটির অধিকাংশ ইসি সদস্যের মত আসে জামায়াতের সঙ্গে জোট করার। তবে সেখানে বিরোধিতা করে এনসিপির একটি পক্ষ। বিএনপির সঙ্গেও জোট করার মতামত আসে বৈঠকে। তবে এখনই চূড়ান্ত হয়নি জোট গঠনের বিষয়টি।
বৃহস্পতিবার ১৭ বছরের নির্বাসন শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। তার সঙ্গে সরাসরি বসে আলোচনা করে জোট গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে এনসিপি। জানা গেছে, জামায়াতের কাছে ৫০টি আসন চায় এনসিপি। জামায়াতকে হাতে রেখেই অন্তত ১৫টি আসনের দাবিতে তারেক রহমানের সঙ্গেও আলোচনা করবে এনসিপি। জামায়াত কিংবা বিএনপি যার সঙ্গেই জোট হোক ভেঙে আরও দুভাগ হয়ে যাবে দলটি। এনসিপির একটি অংশ ইতোমধ্যে তৃণমূল এনিসিপি নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে জোট হলে আরও একটি অংশ বের হয়ে দল গঠনের ঘোষণা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। সব মিলিয়ে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড়ো ধরেন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার কারণে বিএনপি এবং জামায়াত কেন্দ্রীক দু’ভাগে বিবক্ত দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। দলকে ইনক্লুসিভ করতে ইতোমধ্যে অমুসলিমদেরও প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। যুক্ত করা হয়েছে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে। অন্তত তিনজন নারীকেও প্রার্থী ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। জাতীয় নির্বাচনে প্রায় সবগুলো আসনেই প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। এতে এখন পর্যন্ত বড়ো ধরনের সমস্যা তৈরি না হলেও দল থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করবেন বিএনপির অনেক নেতা। যা নিয়ে জোটগতভাবে বিএনপির হয়ে ভোট করেও অস্বস্তিতে অনেক স্বতন্ত্র রাজনেতারা। বিএনপির বিদ্রোহীদের ঠেকাতে না পারাটা সাংগঠনিক দুর্বলতা হিসেবে দেখছে এনসিপি। বুধবার এনসিপির মিটিংয়ে এ বিষয়টিও উঠে আসে। বিএনপি আসন দিলেও সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে জোটের প্রার্থীরা বিপাকে থাকবে। যার কারণে এ বিষয়টি গুরুত্বসহ দেখছে এনসিপি।
জামায়াতের সঙ্গে জোট করার বিষয়ে এনসিপির প্রতিনিধিরা দফায় দফায় বৈঠক করেছে জামায়াত নেতাদের সঙ্গে। মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিসে একাধিক বৈঠক হয়েছে এনসিপির। শুধু এনসিপি নয়, এখানে দলটির সঙ্গে থাকা আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন আসবে জামায়াতের সঙ্গে। এর বাহিরে মগবাজারে আলোচনায় রয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম যুক্ত হতে পারে জামায়াতের সঙ্গে।
পাঁচদফা দাবিতে জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনে থাকা ৭ দল এবং আলোচনায় থাকা এনসিপিসহ ৪ দল আসলে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। আগামী নির্বাচনের মধ্যদিয়ে শহিদ শরিফ ওসমান বিন হাদির ইনসাফের বাংলাদেশ গড়তে চায় জামায়াত। এনসিপিতে থাকা ডানপন্থি নেতারা মনে করছেন জুলাইয়ের স্পিরিটকে বাঁচিয়ে রাখা এবং জুলাই যোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জামায়াতই হতে পারে একমাত্র ভরসা। জামায়াতের সঙ্গে জোট হওয়া এবং সরকার গঠন হলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন এটি নিয়েও আলোচনা চলছে জামায়াত এনসিপির মধ্যে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের জনকণ্ঠকে বলেছেন, জোট হওয়ার বিষয়টি এখনও আলোচনা চলমান। দ্রুতই এই বিষয়ে জানানো হবে। আমাদের সঙ্গে ৭টি দল রয়েছে আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনা চলমান।
জামায়াতের পক্ষ থেকে এনসিপির সঙ্গে আলোচনার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি বলেছেন, আসন সমঝোতা নিয়ে এনসিপির সঙ্গে আলোচনা চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিপির প্রথম সারির দায়িত্বশীল নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, গত এক সপ্তাহ যাবৎ আমাদের দফায় দফায় মিটিং হয়েছে। আমাদের দলীয় প্রধান নাহিদ ইসলামি এবং সদস্য সচিব আক্তারের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের বৈঠক হয়েছে। বিএনপি যখন তার শরিকদের বিভিন্ন আসন দিচ্ছে এবং সেখানে আবার বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়াচ্ছে, তখন বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন প্রক্রিয়াটি কঠিন হয় হয় এবং জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা এগিয়ে যায়।
এদিকে জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন নিয়ে কিছুটা দ্বিমত রয়েছে সম্প্রতি সরকার থেকে পদত্যাগ করা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া, মাহফুজ আলমের কোরাম। এর বাহিরেও গণ-অভ্যুত্থানের পর এনসিপিতে আসা বাম দল ও জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের নেতারাও এনসিপি ছেড়ে নতুন দল গঠন করতে পারে বলে জানা গেছে। এই পক্রিয়ায় নেতৃত্বে থাকতে পারে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইঁয়া। বিএনপির প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা শুরু করেছেন তিনি। বৃহস্পতিবার তারেক রহমানের অভ্যর্থনাকে কেন্দ্র করে বিএনপির ব্যস্ততার কারণে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া কোরাম। জানা গেছে এনসিপির একাধিক প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার রাতে বৈঠক করেছে বিএনপির সঙ্গে। যেখানে তারেক রহমানের সাক্ষাৎ চেয়েছে নাহিদ ইসলাম। আজ যে কোনো সময় তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন নাহিদ ইসলামসহ এনসিপির একটি প্রতিনিধি দল।
এদিকে জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির বোঝাপড়া সৃষ্টি হওয়ার ঘটনায় অনেকটা ব্যস্ততা বেড়েছে ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মধ্যে। শেষ মুহুর্তে এসে আসন সমঝোতা নিয়ে জটিলতায় পড়েছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনসহ আট দল। সংশ্লিষ্ট লিয়াজোঁ কমিটি দফায় দফায় বৈঠক করেও একক প্রার্থী নির্বাচনে কোন সমাধানে আসতে পারেনি। বিশেষ করে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন ও মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আসন চাহিদা অনেক বেশি হওয়ায় এই জটিলতা দেখা দিয়ছে বলে জানা গেছে।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে অংশগ্রহণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রক্রিয়া চালাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি, জাগপা ও বাংলাদেশ ডেভলেপমেন্ট পার্টি। ইসলামী দলগুলোর ভোট একবাক্সে (ওয়ান বক্স নীতি) নিয়ে সরকার গঠনেরও টার্গেটে এগোতে চায় তারা। তবে শেষ মুহূর্তে এনসিপি-এবি পার্টি জোট জামায়াতে যোগ দেওয়ার গুঞ্জনে আসন সমঝোতা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। জানা গেছে, ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের চাহিদা মত আসন সমঝোতা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। অন্যদের চাহিদা পূরণ করলে জামায়াতের আসন অনেক কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রত্যাশা অনুযায়ী আসন না পেলে এই প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে বিকল্প সিদ্ধান্ত এবং আলাদা প্লাটফর্ম করারও চিন্তা রয়েছে কয়েকটি দলের।এনসিপির সূত্র থেকে জানা যায়, নির্বাচনে এনসিপির সঙ্গে থাকা ৩ দলীয় জোট হিসেবে ৫০টি আসন চায় জামায়াতের কাছে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৫-৩০টি আসন ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছে জামায়াত। ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের চাহিদাও একশোর ওপরে আসন। প্রথম থেকেই জামায়াত ১০০ আসন ছেড়ে ২০০টি আসনে নির্বাচনে করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আরও ২০-৩০টি আসন ছাড়তে পারে জামায়াত।