দীর্ঘ ১৭ বছরের লন্ডনের নির্বাসিত জীবন শেষে আগামী ২৫শে ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান । সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিবের ঘোষণার পর মঙ্গলবার লন্ডনের এক অনুষ্ঠানে তারেক রহমান নিজেও এ তথ্য জানিয়েছেন। একইসঙ্গে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে দেশটিতে থাকা দলের নেতাকর্মীদের বিদায় জানাতে ভিড় না করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তবে দেশের বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। তারেক রহমানের স্বদেশপ্রত্যাবর্তন দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখতে স্মরণকালের বৃহত্তম গণজমায়েতের পরিকল্পনা করছে দলটি। ওইদিন রাজধানী ঢাকাকে জনসমুদ্রে পরিণত করতে চায় তারা। ইতিমধ্যে গুলশান কার্যালয়ে প্রস্তুতি সভা করেছে দলটি। গঠন করা হয়েছে অভ্যর্থনা কমিটিও। তারেক রহমানের নিরাপত্তায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে ‘প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা’। কেনা হয়েছে বুলেটপ্রুফ গাড়ি। প্রস্তুতি করা হয়েছে গুলশানের বাসভবন। নতুন করে সাজানো হয়েছে গুলশান ও নয়াপল্টন কার্যালয়ের কক্ষ।
বিএনপি’র দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, স্বৈরাচার হাসিনার রোষানলে পড়ে দীর্ঘদিন লন্ডনে নির্বাসিত জীবন শেষে তারেক রহমানের ঘোষণায় জেলায় জেলায় তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উচ্ছ্বাস। কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনার আগেই তৃণমূল নেতাকর্মীরা নিজেরাই যানবাহন ভাড়া করছেন। শুধু ঢাকা নয়, দেশের সবগুলো জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় থেকে দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ সংবর্ধনায় যোগ দেবেন। তারা বাস, ট্রাক, মাইক্রো, লঞ্চ, ট্রেন ও বিমানযোগে আসবেন।
উত্তরাঞ্চলের জেলা উপজেলা থেকে আসা নেতাকর্মীদের গাড়িবহর টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে রাখা হবে। সেখান থেকে হেঁটে বিমানবন্দর সড়কে জড়ো হবেন তারা। এ ছাড়া পূর্বাঞ্চলের জেলা উপজেলা থেকে নেতাকর্মীদের গাড়িবহর পূর্বাচলের তিনশ’ ফিট সড়কের উভয়পাশে খালি জায়গায় পার্কিং করা হবে। সেখান থেকে হেঁটে নেতাকর্মীরা বিমানবন্দর সড়কে আসবেন। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রেনে করে নেতাকর্মী আসবেন। বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে সংবর্ধনায় যোগ দেবেন। তাই সাধারণ মানুষের যানজটের ভোগান্তি এড়াতে তারেক রহমানের ফেরার ক্ষণটি বড়দিনের ছুটিকে বেছে নেয়া হয়েছে। বিমানবন্দরে দলের সিনিয়র নেতারা থাকবেন। আর বিমানবন্দরের বাইরে থেকে গুলশান কার্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত হবে দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ঢল। তবে বিমানবন্দর থেকে তারেক রহমানের সরাসরি এভারকেয়ার হাসপাতালে অসুস্থ মা বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে যাওয়ার কথা রয়েছে। সেজন্য বিমানবন্দর থেকে এভারকেয়ার হাসপাতাল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে তারেক রহমানকে সংবর্ধনা জানাবেন।
সংবর্ধনা দিতে বিএনপি’র অভ্যর্থনা কমিটি গঠন: এদিকে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে অভ্যর্থনা কমিটি করেছে বিএনপি। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে সদস্য সচিব করে এই কমিটির করা হয়েছে। বিএনপি’র একটি সূত্র জানিয়েছে, অভ্যর্থনা কমিটিতে বিএনপি’র ১০ বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, অঙ্গসংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবরা সদস্য হিসেবে রয়েছেন। মঙ্গলবার (১৬ই ডিসেম্বর) বিকালে অভ্যর্থনা কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। এই বৈঠকে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে অভ্যর্থনার কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সদস্যরা আলোচনা করেন। এর আগে গত সোমবার গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের যৌথ সভা হয়। ওই সভায় তারেক রহমানকে কীভাবে অভ্যর্থনা দেয়া হবে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বিএনপি’র দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, ঢাকায় লোকসমাগম সমন্বয় করবেন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতারা। আর জেলা নেতারা সমন্বয় করবেন নিজেদের জেলা ও উপজেলা থেকে আসা নেতাকর্মীদের।
প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিয়োগ:
বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশের ফেরার বিষয়ে তার নিরাপত্তা নিয়ে সবচেয়ে উদ্বেগে ছিল দলটি। গতকাল সাবেক একজন সেনা কর্মকর্তাকে নিরাপত্তা সমন্বয় করার জন্য ‘প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা’ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে জানানো হয়, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা’ হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এ কে এম শামছুল ইসলামকে। এদিকে তারেক রহমানের পুরো যাত্রাপথে এবং কার্যালয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দলের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে বাছাই করা দক্ষ কর্মীদের নিয়ে একটি বিশেষ নিরাপত্তা দল গঠনের কাজ চলছে।
প্রার্থীদের সঙ্গে বিএনপি’র বৈঠক:
এদিকে দলের ঘোষিত ২৭২ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঢাকায় ডেকেছে বিএনপি। গতকাল থেকে ৩ দিনব্যাপী প্রার্থীদের নিয়ে রাজধানীর গুলশান কার্যালয়ে সভা শুরু হয়। গতকাল দিনব্যাপী নির্বাচনী আসন ১ থেকে ১০৭ পর্যন্ত মনোনয়ন প্রার্থী নিয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রার্থীদের নানা নির্দেশনা দেন। এতে ভোটের প্রচারণার কৌশলসহ বাতলে দেয়া হয়। এ ছাড়া ফি নিয়ে মনোনয়ন ফরম, প্রচারণার সিডি, ক্যাপসহ প্রচারণার সরঞ্জামের একটি বক্স প্রার্থীদের সরবরাহ করা হয়। সভায় স্থগিত আসনগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আজ দ্বিতীয় দিনেও নির্বাচনী আসন ১০৮ থেকে শতাধিক প্রার্থী নিয়ে সভা হবে।
নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেবেন তারেক রহমান:
এদিকে দেশে ফিরে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচারে অংশ নেবেন তারেক রহমান। বিষয়টি তিনি নিজেই গত সোমবার এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে, ওয়ার্ডে-মহল্লায়, অলিগলিতে, রাজপথে জনগণের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার এই নির্বাচনে মিছিলে আমিও আপনাদের সঙ্গে থাকবো। ওদিকে সময় বিবেচনায় রেখে বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ আয়োজনের কথা ভাবছে বিএনপি। জনসভাগুলোয় তারেক রহমান সশরীরে অংশগ্রহণ করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সাজানো হচ্ছে বাসভবন ও অফিস:
এদিকে গুলশানে দলের চেয়ারম্যানের বাসা ও কার্যালয় এবং নয়াপল্টনে অবস্থিত দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তারেক রহমানের জন্য নির্ধারিত কক্ষের বিশেষ সাজসজ্জা চলছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই উভয় কার্যালয়ে চেয়ারম্যানের বসার জন্য নির্ধারিত কক্ষের সাজসজ্জা চূড়ান্ত হবে। দরজা লাগানো বাদে মোটামুটি প্রায় সব কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। বিএনপি সংবাদ সম্মেলনে জানায়, গুলশান এভিনিউয়ের ১৯৬ নম্বর বাসায় উঠবেন তারেক রহমান। এই বাসার পাশেই ভাড়া করা বাসা ‘ফিরোজা’য় থাকেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তারেক রহমানের জন্য নির্ধারণ করা গুলশান এভিনিউয়ের বাসাটি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়াকে বরাদ্দ দেন। কয়েক মাস আগে এ বাড়ির দলিলপত্র বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে হস্তান্তর করেন অন্তর্বর্তী সরকারের গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম রিজু। সে বাড়িতেই উঠবেন তারেক রহমান। এরই মধ্যে এ বাসার সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে আপাতত মায়ের সঙ্গে ‘ফিরোজা’য় থাকার সম্ভাবনা বেশি বলে জানা গেছে। এ ছাড়া দেখা গেছে, নতুন বাসার সামনে নিরাপত্তা ছাউনি বসানো হয়েছে। সড়কের সামনে স্থাপন করা হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশবাসী আমাদের নেতার অপেক্ষায় আছে। ২৫শে ডিসেম্বর দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী সড়কের দুই পাশে সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থান নিয়ে প্রিয় নেতাকে অভ্যর্থনা জানাবেন। আমরা সেই প্রস্তুতির কাজ করছি।
বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব এমরান সালেহ প্রিন্স মানবজমিনকে বলেন, বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ফেরার ঘোষণার পর থেকেই দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছে। শুধু দলের নেতাকর্মী নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও সেই উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে স্বাগত জানাতে শুধু সারা দেশের জেলা উপজেলা নয়, ইউনিয়ন পর্যায় থেকেও নেতাকর্মী ঢাকায় আসবে। তারা নিজেরাই বাস-ট্রাক মাইক্রো ভাড়া করছে। ২৫ তারিখ শুধু ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে কয়েক লাখ লোক ঢাকায় যাবে। ইজতেমা মাঠে গাড়ি রেখে হেঁটে বিমানবন্দরে যাবো। আমরা সুশৃঙ্খলভাবে আমাদের নেতাকে স্বাগত জানাবো।
যুবদলের সভাপতি মোনায়েম মুন্না মানবজমিনকে বলেন, তারেক রহমান তারুণ্যের আইকন। তার ফেরার খবরে দলের নেতাকর্মী ও দেশের তরুণদের মধ্যে জোয়ার তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় যুবদল, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে তারেক রহমানকে স্বাগত জানাবেন। আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি।
ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল হাসান রাকিব মানবজমিনকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পর দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার ফেরার দিনটিকে আমরা স্মরণীয় করে রাখতে চাই। কেন্দ্রীয় ছাত্রদল, রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ শাখার ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বিমানবন্দরে সংবর্ধনায় যোগ দিবেন। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা ঢাকায় আসবেন।