চট্টগ্রামে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর প্রকাশ্যে গুলি বর্ষণকারী আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বেশির ভাগই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। তাদের ভান্ডারে থাকা অবৈধ অস্ত্র গোলাবারুদও পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি। উদ্ধার হয়নি থানা থেকে লুটের অস্ত্র গুলির একটি অংশ। এই অবস্থায় আসন্ন নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভোটের আগে এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং নিয়ন্ত্রণই প্রশাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে।
নজিরবিহীন এক রক্তাক্ত বিপ্লবের মুখে ফ্যাসিবাদি শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। চট্টগ্রামেও তার দোসরেরা পালিয়ে যায় দেশে-বিদেশে। তবে তাদের গোপন অস্ত্রভান্ডার প্রায় অক্ষত থেকে যায়। জুলাই আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন ঠেকাতে বিপুল অস্ত্র নিয়ে মাঠে নামে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও তাদের সহযোগীরা। প্রকাশ্যে তারা পাখির মতো গুলি করে ছাত্র হত্যা করে। চট্টগ্রামে ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, শিবির নেতা শান্তসহ ১৬ জনের প্রাণ যায় হাসিনার ক্যাডার বাহিনীর গুলিতে। সশস্ত্র খুনিরা পিস্তল, শটগান ও কাটা বন্দুক, এসএমজিসহ শতাধিক অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। পরবর্তিতে মিডিয়ায় প্রকাশিত ছবি দেখে ৪৬ অস্ত্রধারীকে চিহ্নিত করা হয়। তাদের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ১৯ জনকে। যাদের অনেকে জামিনে বের হয়ে গেছে। আর বাকিরা এখনো গ্রেফতার হয়নি।
এদিকে গত বছর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনার মামলা তদন্তেও তেমন গতি নেই। এখন পর্যন্ত কেবল একটি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। মামলার বেশিরভাগ আসামি ধরা পড়েনি। হতাহতের ঘটনায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় ৬৯টি মামলা হয়। এর মধ্যে ১৫টি হত্যা মামলা। এসব মামলায় মোট আসামি ২১ হাজার ৯০৬ জন। এর মধ্যে নাম উল্লেখ করা আসামির সংখ্যা সাত হাজার ২২৬ জন। আর অজ্ঞাতপরিচয় আসামি ১৪ হাজার ৬৮০ জন। এ পর্যন্ত আসামি গ্রেফতার হয়েছেন এক হাজার তিনশ জনের মতো। আসামির বিপরীতে গ্রেফতার মাত্র ৫ শতাংশ।
বিগত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের এক শ্রেণির নেতাকর্মী বিভিন্ন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বিভিন্ন বাহিনীর নামে তারা সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করে এক একটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের ভান্ডারে ছিলো বিপুল অস্ত্র গুলি। সরকার পতনের পর ক্যাডারেরা পালিয়ে গেলেও তাদের অস্ত্রভান্ডারে পুলিশের হাত পড়েনি। অপরদিকে গণআন্দোলনে সরকার পতনের আগে-পরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় আক্রমণ চালিয়ে লুটপাট করা অস্ত্রের বড় একটি অংশের খোঁজ মিলছে না। শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর দিন গত বছরের গত ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন এলাকার মত চট্টগ্রামে পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনাতেও হামলা হয়। আগুন দেয়া হয় নগরীর কোতোয়ালী, পাহাড়তলী, পতেঙ্গা ও ইপিজেড থানায়। লুটপাট করা হয় অস্ত্র ও মালখানা।
পুলিশের হিসাবে নগরীর ১৬টি থানার মধ্যে ছয়টি থানার অস্ত্র লুট হয়। ছয়টি থানার বিভিন্ন ধরনের মোট ৮১৫টি অস্ত্র লুটের তথ্য পাওয়া যায়। যার মধ্যে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ৬১৭টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র গুলির প্রায় পুরোটাই উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি কিছু অস্ত্র উদ্ধার হয়নি, এসব অস্ত্র উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান চলছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত জেলা পুলিশ ও গোয়েন্দা শাখার অভিযানে ৫৭৭টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৪৬২টি গুলি ও ২০৬ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছে। অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছে ৯৬টি এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ১৪০ জনকে। এছাড়াও গত নভেম্বর মাসে রাউজান থানা এলাকায় অস্ত্র আইনে দায়ের হয়েছে ১০টি মামলা। গ্রেফতার করা হয়েছে ৮ জনকে এবং উদ্ধার করা হয়েছে ২৪টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৮৫ রাউন্ড গুলি ও ৩২টি কার্তুজ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের পতনের পর অনেক অনেক সন্ত্রাসী জামিনে বের হয়ে এসেছে। অপরাধ জগতে নতুন মেরুকরণ হচ্ছে। এর জের ধরে গত দেড় বছরে নগরী ও জেলায় বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গত নভেম্বরে নগরীর বায়েজিদ থানার চালিতাতলী এলাকায় বিএনপির নেতা এরশাদ উল্লাহর প্রচার মিছিলে গুলির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। গুলিতে মারা যান যুবদল কর্মী সরোয়ার হোসেন বাবলা। নির্বাচনি প্রচারে গুলিবর্ষণের ঘটনায় জড়িত মূল আসামিকে এখনো গ্রেফতার করা যায়নি। নগরীর এবং জেলার বিভিন্ন এলাকায় সংগঠিত খুন ও অস্ত্রবাজির ঘটনায় জড়িদের অনেকেই এখনো অধরা। এই অবস্থায় এসব অস্ত্রধারীরা নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিঘিœত করতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে। তার সাথে যোগ হয়ে পলাতক ফ্যাসিবাদীদের হুমকি। তারা নির্বাচন বানচালের হুমকি দিয়ে চলেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের ক্যাডারেরা নাশকতামূলক কর্মকা-ে লিপ্ত হতে পারে।
তবে চট্টগ্রাম মেট্রেপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, নির্বাচন নিয়ে কোন অপশক্তিকে পরিস্থিতি গোলাটে করার সুযোগ দেয়া হবে না। নগরীর ১৬টি থানা এলাকায় অস্ত্র উদ্ধার এবং সন্ত্রাসী গ্রেফতারে অভিযান চলছে, তফসিল ঘোষণার পর অভিযান আরো জোরদার করা হয়েছে। অপরাধীদের গ্রেফতার এবং অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ আন্তরিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, থানা থেকে লুটের প্রায় ৮০ ভাগ অস্ত্র গুলি উদ্ধার হয়েছে। বাকি অস্ত্রও উদ্ধার হবে। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করতে সবকিছুই করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব পলাশ বলেন, অন্য সময় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রেফতারে বিশেষ অভিযান শুরু হতো। কিন্তু এবার আমরা গত দেড় বছর ধরে অভিযান পরিচালনা করে আসছি। অভিযানে অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে, সন্ত্রাসী গ্রেফতার হচ্ছে। নির্বাচনে কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যেকোন অপচেষ্টা আমরা কঠোর হাতে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত।