দেশের গণতন্ত্র-চর্চার ইতিহাস নতুন বাঁক অতিক্রম করছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দেড় বছরের মাথায় জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই করছে এবং দীর্ঘদিন থেকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষ ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সারা দেশের গ্রামাঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারণার উৎসব শুরু হয়ে গেছে। গোটা জাতি যখন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন হিন্দুত্ববাদী চাণক্যনীতির ভারত ও মাফিয়াচক্রের নেত্রী শেখ হাসিনা ভোটের উপর হিং¯্র শকুনি থাবা বসাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসিনা যেমন হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, তেমনি দেশে-বিদেশে থাকা তার অলিগার্করা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার দৌড়ে জুলাই অভ্যুত্থানের স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের সামনে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে বিভেদে জড়িয়ে যাচ্ছে। কাদা ছোড়াছুড়ির ঘটনাও কম ঘটছে না। তবে দিল্লিতে পলাতক মৃত্যুদ-প্রাপ্ত খুনি শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা, মাফিয়াতন্ত্রের আওয়ামী লীগ এবং তাদের রাজনৈতিক মুরুব্বি ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে সবার মধ্যে ঐক্য যেন সুদৃঢ়, অটুট রয়েছে। ইনকিলাব মঞ্চের মুখোপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী তরুণ রাজনীতিক শরীফ ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধের লোমহর্ষক ঘটনা জুলাই চেতনার সব শক্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেÑ জুলাইযোদ্ধা ও ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী শক্তির অগ্রসেনানি শরীফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার অপরাধীকে ধরিয়ে দিলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষ জেনে গেছে, হাদি হত্যাচেষ্টার প্রধান ঘাতক ফয়সাল করিম মাসুদ নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা। ঘাতক ফয়সাল ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি এবং আদাবর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো এই ঘাতককে গ্রেফতার করতে না পারলেও তার রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিষ্কারÑ হাদির উপর গুলিবর্ষণের ঘটনা নির্বাচন ঠেকাতে হাসিনা ও ভারতের নীলনকশার অংশ হতে পারে। এমন সন্দেহের যথেষ্ট কারণও রয়েছে। ইনকিলাব মঞ্চের মুখোপাত্র হাদি জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে আওয়ামী লীগ ও ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে; তিনি ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনেও ছিলেন। হাদি জানিয়েছেন, এর আগে ভারতের কয়েকটি ফোন নম্বর থেকে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে; এমনকি তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া ও পরিবারের মেয়েদের ধর্ষণের হুমকি দেয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি-বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও জানিয়েছেন, ভারতের ফোন নম্বর থেকে ফোন করে হাদিকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। ফলে এটি পরিষ্কার, হিন্দুত্ববাদী ভারত ও তাদের পোষ্য খুনি হাসিনা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টা করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় যেমন সব রাজনৈতিক শক্তি মাফিয়াতন্ত্রের আওয়ামী লীগ ও ভারতের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে দিল্লিতে পালাতে বাধ্য করেছে; সেই ইস্পাতকঠিন ঐক্য এখন অপরিহার্য।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর গতকাল শরীফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ভারতের জড়িত থাকার ইঙ্গিত করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের হাসিনা নির্বাচন ঠেকানো ও হত্যকা-ের সব পরিকল্পনা করছে দিল্লিতে বসে। ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদ ছাড়া আওয়ামী লীগ এ ধরনের পরিকল্পনা করতে পারে না। এ ধরনের তৎপরতা, জঙ্গি তৎপরতা করছে। ফলে অবশ্যই ভারত সরকারকে আমাদের এখানে যারা ভারতীয় দূতাবাস আছে, তাদের অ্যাকাউন্টেবল করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ডেকে বলতে হবে যে, সেখানে একজন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত গণহত্যাকারীকে ভারত সরকার আশ্রয় দিয়ে অলরেডি তারা একটি নৈতিক অপরাধ করেছে। এখন তারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য আওয়ামী লীগকে সহায়তা করছে। তিনি আরো বলেন, জনগণই আমাদের নিরাপত্তা। সেই জনগণের কাছেই আমাদের নিরাপত্তা নিতে হবে। রাজনৈতিক দায়িত্বটা আমাদের পালন করতে হবে। সরকার অবশ্যই প্রশাসনিকভাবে করবে। প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের লোকেরা আছে, পুলিশের বিভিন্ন জায়গায় আছে এবং মিডিয়া থেকে শুরু করে নানান ছদ্মবেশে আওয়ামী লীগ আসছে। সরকারকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইনকিলাব মঞ্চের ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার পর সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে জেলা,-উপজেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। অপরাধীকে ধরতে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ভারত ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন ঐক্যের দাবি জানানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নির্বাচনে প্রস্তুতি নেয়া রাজনৈতিক দলগুলো তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ঘাতককে গ্রেফতার এবং সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের রুখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ উঠে। হাসিনার দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র এবং ভারতের চাণক্যনীতির প্রতিবাদের অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর পদক্ষেপ না দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এর আগে চট্টগ্রামে বিএনপির এক সম্ভাব্য প্রার্থীকে গুলি করা হয় এবং পাবনায় বিএনপির সমাবেশে গুলির ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত মানুষ তা জানতে পারেনি। পাবনার ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হলেও পুলিশ গুলি ছোড়া অস্ত্রধারী জামায়াতকর্মীকে ধরে ফেলে। রহস্যজনক কারণে সে ঘটনা নিয়েও চলছে নীরবতা। দেশের ডান-বাম-মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল, সমাজিক সংগঠন এবং সব শ্রেণিপেশার মানুষ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, তারা আওয়ামী লীগ ও দিল্লির চাণক্যনীতির বিরুদ্ধে সজাগ রয়েছে এবং ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ।
ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই সময়ের সাহসী সন্তানের মতোই এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জুলাইয়ের পক্ষের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেন। তিনি বলেন, ‘সবাই ঐক্যবদ্ধ হোন, আমরা ঐক্যের ডাক দিচ্ছি, আহ্বান জানাচ্ছি। জুলাইয়ের স্পিরিট ধারণ করা আমাদের দল-মত ভিন্ন হতে পারেÑ আমাদের ব্যানার ভিন্ন হতে পারে; কিন্তু জুলাইয়ের প্রশ্নে, বাংলাদেশের প্রশ্নে আমরা ঐক্যবদ্ধ। নির্বাচন বানচালের আওয়ামী ষড়যন্ত্র রুখতে আমরা এখন থেকেই মাঠে থাকব।’ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে গতকাল রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকের পর আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল রাজনৈতিক দলগুলোকে হাসিনা ও ভারতের চক্রান্ত সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হানাহানি শুরু হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়েছে। আপনাদের শুধু দলীয় স্বার্থ নয়, জাতীয় স্বার্থের বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ওসমান হাদির মতো নেতার উপর পৈশাচিক আক্রমণের পর প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। এ সময় তিনি জুলাই অভ্যুত্থানের মুখ শরীফ ওসমান বিন হাদির ওপর হামলার প্রেক্ষাপটে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। ক্ষমতাচ্যুত শক্তি নির্বাচন বানচাল করতে চাইছে বলে দলগুলোকে সতর্ক করেন। দলগুলোর নেতারাও প্রধান উপদেষ্টাকে প্রতিশ্রুতি দেন, নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে তারা দ্বন্দ্ব ভুলে এক থাকবেন।
ওসমান হাদির ওপর হামলা একটি সতর্কবার্তা হিসেবে নিতে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই হামলা পূর্বপরিকল্পিত ও গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ; এর পেছনে বিরাট শক্তি কাজ করছে। ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনটি না হতে দেয়া। এই আক্রমণটি খুবই ‘সিম্বলিক’। এ পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে মনে হচ্ছেÑ ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। তারা প্রশিক্ষিত শুটার নিয়ে মাঠে নেমেছে। তারা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায়, নির্বাচনের সব আয়োজন ভেস্তে দিতে চায়। আমরা (রাজনৈতিক দল) নিজেদের মধ্যে যেন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে না পড়ি, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাজনৈতিক বক্তব্য থাকবে; কিন্তু কাউকে শত্রু ভাবা বা আক্রমণ করার সংস্কৃতি থেকে সরে এসে শত্রুর ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সালাহউদ্দিন বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে আমাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। যেকোনো অবস্থাতেই পরস্পরের দোষারোপ থেকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের মধ্যে যতই রাজনৈতিক বক্তব্যের বিরোধিতা থাকুক না কেন, জাতির স্বার্থে ও জুলাইয়ের স্বার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতেই হবে।’ এনসিপির হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারলে কোনো নিরাপত্তাই আমাদের কাজে আসবে না।’
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের নানা বক্তব্য একে অন্যকে দোষারোপ করার প্রবণতা বাড়িয়েছে, যার ফলে আমাদের বিরোধীরা সুযোগ পেয়েছে। ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে আমরা একে অন্যকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছি। জাতিকে বিভক্ত করে এমন কথা আমরা কেন বলব? আমাদের আগের মতো ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর এটি পরিষ্কারÑ মতভেদ ও নির্বাচন ইস্যুতে যতই কাদা ছোড়াছুড়ি হোক, হাসিনার চক্রান্ত রুখতে রাজনৈতিক দলগুলোর দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারতের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঐক্য সুদৃঢ়। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় জাতীয় নির্বাচন কোনো অপশক্তি যাতে ঠেকাতে না পারে, সে জন্য প্রধান উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক দলগুলো একাট্টা।