নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার খুলনা পানি সরবরাহ প্রকল্প (ফেজ-২)-এ পিডি নিয়োগ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে। নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই একদিনের ভেতরে প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ জুয়েলের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত খুলনা ওয়াসার প্রকৌশলী-১ রেজাউল ইসলাম। বিকালে প্রপোজাল মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে সন্ধ্যায় আদেশ আসায় সবাই হতবাক হয়ে পড়েছেন। বিগত আওয়ামী সরকারের সময়ে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের প্যানেল থেকে নির্বাচিত এই নেতা পিডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। ফলে ওয়াসা ভবনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সূত্র জানায়, ওই প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কমপক্ষে ৪র্থ গ্রেডের প্রকৌশলী থাকা অত্যাবশ্যক থাকলেও রাজনৈতিক তদ্বির ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগের মধ্যেই একজন ৬ষ্ঠ গ্রেডের প্রভাবশালী প্রকৌশলীকে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগ দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে খুলনা ওয়াসায় চলছে চরম অসন্তোষ। একটি পক্ষ খুশি হলেও অপর পক্ষটি এটি মেনে নিতে পারছেন না।
সূত্র জানায়, খুলনা পানি সরবরাহ প্রকল্প (ফেজ-২)-এ প্রকল্পটির প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়া হয় গত ৯ই ডিসেম্বর। এটি বাস্তবায়িত হবে বাংলাদেশ সরকার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) যৌথ অর্থায়নে। মেয়াদ- ১লা অক্টোবর ২০২৫ থেকে ৩০শে জুন ২০৩০। এ প্রকল্পের ফোকাল পার্সন হিসেবে বর্তমান দায়িত্বে রয়েছেন ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামাল হোসেন পিইঞ্জ। আর তাকে ওই পদ থেকে অপসারণ না করেই নতুন পিডি হিসেবে নির্বাহী প্রকৌশলী-১ রেজাউল ইসলামকে নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে এই দুই প্রকৌশলীর মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয়েছে। আর এ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন স্বয়ং বোর্ড পরিচালক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সব মিলিয়ে খুলনা ওয়াসা ভবনে এখন হ-জ-ব-র-ল অবস্থা।
অভিযোগ রয়েছে এই প্রকল্পে পিডির জন্য খুলনার চারজন প্রকৌশলী যথাক্রমে প্রকৌশলী (৫ম গ্রেড) সেলিম আহমেদ, প্রকৌশলী (৬ষ্ঠ গ্রেড) রেজাউল ইসলাম, প্রকৌশলী (৬ষ্ঠ গ্রেড) মো. কামাল হোসেন পিইঞ্জ এবং প্রকৌশলী (৬ষ্ঠ গ্রেড) আরমান সিদ্দিকী আবেদন করেন। কিন্তু তাদেরকে নিয়োগ বোর্ডে না ডেকেই প্রকৌশলী (৬ষ্ঠ গ্রেড) রেজাউল ইসলামকে নিয়োগ দেন।
বৃহস্পতিবার বিকালে পাঠানো স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার বিভাগ পরিকল্পনা-৩ শাখার উপ-সচিব ইবাদত হোসেন স্বাক্ষরিত এক আদেশ (স্মারক নং ৪৬.০০.০০০০.০৯৫.১৪.১৫৯.২০২৪-৭০১) পত্রে বলা হয়েছে- খুলনায় গ্রেডভুক্ত কোনো কর্মকর্তা না থাকায় ৫ম গ্রেডভুক্ত একমাত্র কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রেজাউল ইসলাম প্রকল্প পরিচালক (রুটিন দায়িত্ব) হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
ওই আদেশে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রেজাউল ইসলামকে ৫ম গ্রেডের কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তিনি ৬ষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তা। ৫ম গ্রেডের কর্মকর্তা হলেন প্রকৌশলী সেলিম আহমেদ।
সূত্র জানায়, গত বুধবার বিকালে (১০ই ডিসেম্বর) খুলনা ওয়াসার নতুন এমডি মোহাম্মদ কামরুজ্জামান যোগদান করেন। তবে অফিস শুরু করেন পরের দিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকে। ওই দিন সকালে দপ্তরে হাজির হন ২০২৪ সালে ৫ই আগস্ট পরবর্তী ছাত্র প্রতিনিধি থেকে নতুন নিয়োগ পাওয়া বোর্ড সদস্য ইব্রাহিম খলিল। যার সঙ্গে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আলোচিত সমন্বয়ক নুসরাত তাবাস্সুম, খুলনা-১ আসনে এনসিপি থেকে মনোনয়ন পাওয়া অহিদুজ্জামান, তাদের সহযোগী আলিফ, আরিয়ান, সাব্বির ও সাইম। এ সময় তারা নিয়োগ পদোন্নতিসহ ওয়াসার ফেস-২ প্রকল্পের পিডি নিয়োগ নিয়ে এমডিকে চাপ সৃষ্টি করেন। বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের নাম ব্যবহার করে এমডিকে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর ফাইল প্রসেস করার জন্য চাপ দেয়া হয়। তারা ওয়াসা ভবন ত্যাগ করার কয়েক ঘণ্টা পর ওই প্রকৌশলীকে পিডি নিয়োগ দিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ আসে।
অভিযোগ রয়েছে দুইজন বোর্ড সদস্য ও ছাত্র প্রতিনিধিরা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এমনটি করেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। যা নিয়ে এখন চলছে নানা বির্তক।
এ ব্যাপারে খুলনা ওয়াসার তরুণ বোর্ড সদস্য ও ওয়াসার ছাত্র প্রতিনিধি ইব্রাহিম খলিল, বৃহস্পতিবার সকালে নুসরাত তাবাস্সুমসহ অন্যদের নিয়ে খুলনা ওয়াসা ভবনে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, নতুন এমডি’র সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে ঢাকা থেকে এসেছিলেন। এ সময় খুলনা-১ আসনে এনসিপি’র প্রার্থী অহিদুজ্জামানের নিজ নির্বাচনী এলাকায় ওয়াসার কার্যক্রম এবং এলাকাবাসীর কিছু কথা তুলে ধরেন। এ ছাড়া খুলনা ওয়াসার নিয়োগ-পদোন্নতি নিয়ে কিছু কথা হয়েছে। তারা যখন এমডির সঙ্গে কথা বলে তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না। ইব্রাহিম খলিল ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বোর্ডে যোগ দেন।
সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে ‘খুলনা পানি সরবরাহ প্রকল্প (ফেজ-২)-এ প্রকল্পটির প্রাথমিক কাজ শুরু হওয়ার পর এডিবি’র সঙ্গে সকল প্রকার সমন্বয় করার দায়িত্ব পান প্রকৌশলী মো. কামাল হোসেন পিইঞ্জ। ২০২৪ সালের ৩০শে মে তৎকালীন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ পিইঞ্জ স্বাক্ষরিত এক আদেশে মো. কামাল হোসেন পিইঞ্জকে প্রকল্পের ফোকাল পার্সন হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ওই আদেশে বলা হয়, এ দায়িত্ব পালনকালে তিনি অন্য কোনো প্রকল্পে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। ফলে তিনিই এখনো পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
নিয়োগ বোর্ডে তাকে ডাকা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে মো. কামাল হোসেন পিইঞ্জ বলেন, আমাকে নিয়োগ পরীক্ষায় ডাকা হয়নি। মন্ত্রনালয় থেকে এ সংক্রান্ত কোন চিঠি পাইনি। অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন প্রকল্পে ফোকাল পার্সন হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করছি। ওই পদ ছাড়ার কোনো আদেশ পাইনি। আদেশ পেলে দায়িত্ব ছেড়ে দেবো।
জানতে চাইলে অপর প্রকৌশলী সেলিম আহমেদ বলেন, খুলনা থেকে আমরা চারজন আবেদন করেছিলাম। কিন্তু নিয়োগ বোর্ডে আমাকে ডাকা হয়নি।
তবে পিডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রেজাউল ইসলাম এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, খুলনা থেকে আবেদন করার পর আমাদের সকলের নিয়োগ সাক্ষাতকার নেয়া হয়। সেখানে তারা আমাকে বিবেচনা করে পিডি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে একসময় ছাত্রলীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা প্রকৌশলী মো. রেজাউল ইসলাম ৫ আগষ্টের পর নিজেকে ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে ফায়দা লুটছেন। বৃহস্পতিবার সারাদিন অফিস করেছেন- তাহলে নিয়োগ সাক্ষাতকার কীভাবে দিলেন? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন এবং কোন সদুত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দেন। এদিকে বৃহস্পতিবারের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সদ্য যোগদানকৃত ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মাদ কামরুজ্জামান বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি, প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই জানি না। ছাত্র প্রতিনিধিদের চাপ দিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন কাল অফিসে আসেন।