Image description

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ঋণ খেলাপির মতো কৃষি ঋণেও খেলাপি বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে সর্বোচ্চ। পাশাপাশি কৃষি ঋণেও খেলাপির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে দেশে বিতরণ হওয়া কৃষি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ২০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা।  অর্থাৎ বিতরণ হওয়া ঋণের ৩৩.৯১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

ব্যাংকাররা জানান, এই খাতের বিশেষ সুবিধা তুলে নেয়ায় সমস্যাগ্রস্ত ঋণ বাড়ছে। তবে দ্রুতই এটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলেও জানিয়েছেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর পর্যন্ত কৃষি ঋণে খেলাপির সবচেয়ে বড় বোঝা বহন করছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৯টি ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলোর কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ ৩৯ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা হলেও খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪৬.৯৩ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো একই সময়ে কৃষি খাতে ১৮ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা, যা মাত্র ৮.১৬ শতাংশ। এ খাতে বিদেশি ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ ৯৭০ কোটি টাকা। উল্লেখযোগ্যভাবে, এসব ব্যাংকের কোনো খেলাপি ঋণ নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যেতে গিয়েই সময়সীমায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এতে সাময়িকভাবে খেলাপি বেড়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে অনুসরণ করেই কৃষকদের বিভিন্ন ধরনের নীতি সহায়তায় নিয়ে আসবে। যাতে কৃষকরা কোনো ধরনের সমস্যার মধ্যে না পড়েন। তবে খুব দ্রুতই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আগে কৃষি খাতের ঋণের ক্ষেত্রে সাব-স্ট্যান্ডার্ড হতে সময় লাগতো ১ বছর, ডাউটফুলে ৩ বছর এবং ব্যাড লোন হতে সময় লাগতো ৫ বছর। কিন্তু নতুন নীতিমালায় এই সময়সীমা কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৩, ৬ ও ১২ মাসের মধ্যে খারাপ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। ফলে আগে যেসব ঋণ নিয়মিত ছিল, সেগুলো এখন দ্রুতই খেলাপির তালিকায় চলে আসছে। এই নীতি গত জুন মাসে কার্যকর করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চে কৃষি ঋণে খেলাপি ছিল ৯ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ১৩.৩ শতাংশ। কিন্তু অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণ হওয়া ঋণের ৩৩.৯১ শতাংশ। আর ২০২৪ সালের জুনে এই ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা বা ৮.৩ শতাংশ। 

তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে ব্যাংকগুলো মৎস্য খাতে ১ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। প্রাণিসম্পদ ও পোল্ট্রি খাতে দেয়া হয়েছে ৩ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। পাশাপাশি, চার মাসে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমে ৫২২ কোটি, শস্য উৎপাদন খাতে ৫ হাজার ৬২৩ কোটি, কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে ৬০ কোটি, সেচযন্ত্র ক্রয়ে ৪৮ কোটি এবং শস্য মজুত ও বিপণন খাতে ১৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক।

বিশ্লেষকরা বলেন, কৃষি খাতে খেলাপি বেড়ে গেলে উৎপাদন, রপ্তানি, এমনকি দেশ জুড়ে মূল্যস্ফীতিতে চাপ তৈরি হবে। এজন্য দেশের খাদ্য ব্যবস্থার চালিকাশক্তি কৃষিকে অবশ্যই নীতি সহায়তার আওতায় আনা দরকার। কারণ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। সেক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তির ব্যবহারসহ কৃষিকে আধুনিকায়নে বিভিন্ন সহায়তা স্কিম তৈরি করা যেতে পারে। 

কৃষিবিদ ও ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএসএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গ্রামীণ জনশক্তিকে অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হলো কৃষিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতে উৎপাদন বাড়বে, স্থানীয় শিল্প গড়ে উঠবে এবং গ্রামীণ পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এজন্য কৃষি ঋণ সহজ করতে হবে। পাশাপাশি কৃষকের উৎপাদিত পণ্যকে ভিত্তি করে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন করতে হবে। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছর ব্যাংকগুলো মোট ৩৯ হাজার কোটি টাকার কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।