টানা ১২ দিন অসুস্থ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ‘অত্যন্ত সংকটাপন্ন’ অবস্থায় তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন। এখন তার দিকেই সরকার, রাষ্ট্র, নির্বাচন কমিশন-সবার মনোযোগ। অনেকের মতে, দেশের আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথও তাকে কেন্দ্র করেই যেন আবর্তিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে-খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে কেন্দ্র করেই যেন সবকিছু থমকে আছে!
বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল যেমন গত কয়েকদিনে থেমে গেছে; তেমনই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সংঘাত-সহিংসতাও কমে গেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, খালেদা জিয়ার অসুস্থতার প্রভাব পড়েছে দেশের সামগ্রিক রাজনীতিতে। শুধু আওয়ামী লীগ ছাড়া সব দল যেমন তার আরোগ্য কামনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তেমনই খালেদা জিয়া সত্যিকার অর্থেই একজন সর্বজনীন নেতায় পরিণত হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, খালেদা জিয়ার মতো অভিভাবক অসুস্থ হওয়ায় সরকার, রাজনীতি ও নির্বাচন-সবকিছুই থমকে আছে। কারণ, খালেদা জিয়া না থাকলে দেশ অভিভাবকহীন হবে। এ কারণেই রাষ্ট্র, সরকার এবং দেশবাসী-সবাই চিন্তিত। দেশের আজ এ সংকটকালে সবাই বুঝতে পারছেন খালেদা জিয়াকে দেশের জন্য কতটা প্রয়োজন। এ কারণে সবকিছু থমকে আছে। এ ঘটনায় সব দলের নির্বাচনি প্রচারণায়ও ভাটা পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরীর মতে, খালেদা জিয়া দেশের রাজনীতিতে সর্বশেষ বাতিঘর। ফলে তার অসুস্থতার দিকে তাকিয়ে পুরো দেশ। তার মতে, খালেদা জিয়ার অসুস্থতায় রাজনীতির গতিপথ অনেকটা থমকে গেছে। বিএনপির প্রচারে ভাটা পড়েছে। চিন্তিত হয়ে পড়েছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও। দলগুলোর মেরুকরণও অনেকাংশে আটকে আছে। অন্যদিকে সরকারও গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছে। কারণ, খালেদা জিয়া বেঁচে থাকলে দেশের রাজনীতি অনেকখানি স্থিতিশীল থাকবে বলে আলোচনা আছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, নির্বাচনি প্রচারণা এবং তারেক রহমানের ফিরে আসা-দুটির সঙ্গেই খালেদা জিয়ার অসুস্থতার সম্পর্ক আছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রও তো এখন এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে। কারণ, খালেদা জিয়ার বর্তমানে সুষ্ঠু নির্বাচন করা অনেকটাই সহজ। তিনি এখন ঐক্যের প্রতীক। তার কথা সবাই শোনেন। ফলে তিনি না থাকলে দেশের মানুষ কার কথা শুনবেন, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, শেখ হাসিনার পালানোর পর খালেদা জিয়া অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছেন। তাকে এখন দেশবাসী ঐক্যের প্রতীক মনে করেন। এ কারণে তিনি না থাকলে কী হবে, সেই আলোচনা সামনে এসেছে। সরকার পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খালেদা জিয়া অসুস্থ হওয়ায় শুধু বিএনপি চিন্তিত হয়ে পড়েনি; অস্থিরতা ছড়িয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য রাজনৈতিক দলের মধ্যেও। খালেদা জিয়া কেমন আছেন-এমন আলোচনা ও কৌতূহল এখন দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও। কারণ, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। ফলে অনেকে ভোটের সঙ্গে খালেদা জিয়ার দেশে থাকা-না-থাকার হিসাব মেলাচ্ছেন। অন্যদিকে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও দলটির সমর্থকরা নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার গুঞ্জন ছড়াচ্ছেন।
বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, দেশের সব মানুষ খালেদা জিয়ার জন্য চিন্তিত হওয়ার কারণ হলো, তিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা। তার ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তিকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। একসময় মনে করা হতো হাসিনা ছাড়া দেশে কোনো নেতা নেই। কিন্তু ৫ আগস্টের পর খালেদা জিয়া অবিসংবাদিত নেতা হয়ে গেলেন। সবাই তাকে পছন্দ করেন।
অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীর মতে, খালেদা জিয়ার অসুস্থ হওয়ার পর অনেক কিছু থমকে যাওয়ার কারণ হলো-নির্বাচন নিয়ে একটা অনিশ্চয়তার কথা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া চিন্তিত হবেই না বা কেন, দেশের রাজনৈতিক দল আছে দুটি। একটি বিএনপি, অন্যটি জামায়াত। এখন বিএনপির ভরসা হলো খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। খালেদা জিয়া না থাকলে তারেক রহমান হাল ধরবেন। কিন্তু তিনি না আসায় বেশি করে অপপ্রচার শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, পলিটিক্যাল ক্রাইসিস বা কনস্টিটিউশনাল ক্রাইসিস দেখা দেবে। কিন্তু নির্বাচন হয়ে গেলে এসব গুঞ্জন থাকবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অস্থিরতাও আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে। নির্বাচনে তিনটি আসনে খালেদা জিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা রয়েছে। এছাড়া বিএনপির প্রার্থীদের এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা নির্বাচনি প্রচারণায়। প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়ে বিএনপি ও জামায়াতের অনেক নেতা এলাকায় চলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন প্রার্থীরা অনেকেই এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে এসেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। যদিও তারেক রহমানের নির্দেশে তাদের কেউ কেউ আবারও প্রচারণায় নেমেছেন। কিন্তু কেউ কেউ এমনটাও বলছেন, তাদের মনের জোর কমে গেছে। এ কারণে প্রচারণায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। চিন্তিত প্রার্থীরা এ কারণে প্রিয় নেত্রীর দ্রুত আরোগ্য কামনায় নির্বাচনি প্রচারণায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিল কর্মসূচি যুক্ত করেছেন।
এদিকে তৃণমূলের পাশাপাশি উদ্বিগ্ন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও। কারণ, শরিক দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতাসহ বিএনপির বিরোধপূর্ণ আসনের মনোনয়নের বিষয়েও তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। সব সময়ই তারা দলীয় নেত্রীর অসুস্থতা নিয়ে বিচলিত। আবার দলীয় চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর সম্পর্কে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ তাদের কাছেই জানতে চাইছেন। তারেক রহমান কবে ফিরছেন-এমন প্রশ্নের জবাবও প্রতিদিন তাদেরই দিতে হচ্ছে। এ আলোচনা বেশি সামনে এসেছে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কারণে। ১১ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণা করার কথা। তফসিলের পর বিএনপি নেতা ও প্রার্থীদের আর বাসায় অথবা ঢাকায় থাকার কোনো সুযোগ নেই। ফলে তফসিলের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিতে উদ্বেগ বাড়ছে।
এদিকে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র খালেদা জিয়াকে সুস্থ করে তোলার বিষয়ে মনোযোগী হয়েছে। ইতোমধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ভিভিআইপি ঘোষণা করে তার বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এছাড়া দলটির ৬৩টি আসনে শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতার পাশাপাশি নিজ দলের প্রার্থীদের মধ্যে আসন চূড়ান্ত করার বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে। কিন্তু দলীয় চেয়ারপারসনের অসুস্থতায় শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারছেন না।
খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমানই নেতৃত্ব দিয়ে দল পরিচালনা করবেন, এটি নিশ্চিত। আবার সেটি তিনি অনেক বছর আগে থেকেই শুরু করেছেনও। কিন্তু নির্বাচন সামনে থাকায় নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয় রয়েছে। তবে খালেদা জিয়া দেশে থাকলে কৌশলগত কারণে তারেক রহমানের ফিরতে দেরি হলেও অসুবিধা নেই। কিন্তু চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া লল্ডনে গেলে তারেক রহমানকে তার সঙ্গে থাকতে হবে-এমন প্রস্তুতি রয়েছে। আবার খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে শুধু বিএনপি নয়; সরকার এবং তার প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেও চিন্তিত। অভিভাবক হিসাবে খালেদা জিয়া দেশে থাকলে সরকারের অনেক সুবিধা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে বিএনপির দু-একটি বিষয় নিষ্পত্তি হয়েছে খালেদা জিয়ার ইঙ্গিতে।
ইতোমধ্যে খালেদা জিয়াকে ভিভিআইপি ঘোষণা করে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে সরকার। তার চিকিৎসা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে মঙ্গলবার উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক করা হয়েছে। বৈঠকে দোয়া ও মোনাজাতের পাশাপাশি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাওয়া হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালের কাছের দুটি মাঠে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার অবতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং তিন বাহিনীর প্রধান খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন।