Image description
ভোট কৌশলে দলগুলো

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ঘোষিত প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছেন অনেকে। তাঁদের স্থলাভিষিক্ত করা হচ্ছে নতুনদের। ২৫ থেকে ৩০টি আসনে এই পরিবর্তন হতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে নতুনভাবে মনোনয়নভুক্ত হওয়ার জন্য কেন্দ্রে লবিং-তদবির থেকে শুরু করে নিজ এলাকায় সভা-সমাবেশ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ চালাচ্ছেন দেদার। আসনভিত্তিক কোন্দলের সঠিক কারণ, প্রার্থীদের দুর্বলতা, মনোনয়নবঞ্চিত নেতার অবস্থান পুনর্মূল্যায়নে গঠিত দলীয় টিমের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই প্রার্থী তালিকা পুনর্মূল্যায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে ঘোষিত আসনগুলোতে প্রার্থী বদলের একক এখতিয়ার বিএনপির হাইকমান্ড ও মনোনয়ন বোর্ডের। দলের নীতিনির্ধারণী মহল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিএনপির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ঘোষিত ২৩৭ জনের তালিকায় যেসব হেভিওয়েট সিনিয়র নেতার নাম আসেনি তাঁদের মধ্য থেকে নতুনভাবে যুক্ত হতে পারেন ১০ থেকে ১২ জন। অন্যদিকে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ও সমমনা দলের নেতাদের মধ্য থেকেও যোগ হবেন কমপক্ষে ২০ জন। নির্বাচন সামনে রেখে ৩ নভেম্বর বিএনপির পক্ষ থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৭টিতে দলীয় প্রার্থীর সম্ভাব্য তালিকা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এটি একটি সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা। চূড়ান্ত তালিকা নয়। এই তালিকার যে কোনো নাম কিংবা আসন যে কোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপির মতো বড় দলে একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বেশ কয়েকটি আসনে যোগ্য প্রার্থী বাদ পড়তে পারেন। হাইকমান্ড সেটি বিবেচনায় নিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। তবে যেসব আসনে বঞ্চিতদের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভ-বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে তা নিরসনের চেষ্টা চলছে। শিগগিরই এসব সমাধান হবে এবং সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে।

দলের দুঃসময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন- এমন নেতাদের প্রার্থী দেওয়ার জন্য বিএনপি হাইকমান্ডের কাছে আবেদন করা হয়েছে। বেশ কিছু আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা এই আবেদন জানিয়েছেন।

তা ছাড়া চট্টগ্রাম-৪ ও ১৬, সিলেট-৬, রংপুর-৩, সাতক্ষীরা-২ ও ৩, গাইবান্ধা-৪, ঠাকুরগাঁও-৩, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২, কুড়িগ্রাম-২, নোয়াখালী-৫, নীলফামারী-৪, দিনাজপুর-২, হবিগঞ্জ-৪, জয়পুরহাট-১ ও ২, ময়মনসিংহ-৩, ৬, ৯ ও ১১, মুন্সিগঞ্জ-২, কুমিল্লা-৫, ৬ ও ১০, চাঁদপুর-২, রাজশাহী-৪ ও ৫, রাজবাড়ী-২, নওগাঁ-১, ৩ ও ৪, পাবনা-৪, মৌলভীবাজার-২ আসনসহ আরও কয়েকটিতে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন চলছে।

সাম্প্রতিক ঘোষিত তালিকায় দলটির অনেক হেভিওয়েট ও আলোচিত নেতার নাম নেই। এর মধ্যে রয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, আসলাম চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আবদুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন-নবী-খান সোহেল, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, হুমায়ুন কবির, সাবেক এমপি ও ডাকসুর সাবেক এজিএস নাজিম উদ্দিন আলম, সাবেক এমপি রুমিন ফারহানা, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সিলেটের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস ও মুন্সিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবদুল হাই।

এ ছাড়াও রয়েছেন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ও সমমনা দলের নেতারা। সব মিলে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব ওই মনোনয়ন তালিকার অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি আসনে পরিবর্তন বা সংশোধনী আনতে যাচ্ছেন। চলতি মাসেই পরিবর্তিত আসনের প্রার্থীদের নামের তালিকা ঘোষণা করা হবে বলে সূত্র জানিয়েছেন।

জানা যায়, বিএনপির প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর অনেক আসনে মনোনয়ন নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। সাংগঠনিক শাস্তির ভয়ে প্রথম দিকে মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা প্রকাশ্যে কঠোর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও ভিতরে ভিতরে বঞ্চনার দুঃখ-বেদনা এবং ক্ষোভ-বিক্ষোভে ফুঁসছেন। ইতিমধ্যে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ থেকে কমপক্ষে ১২টি জেলায় বিভিন্ন আসনে বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, সড়ক ও রেলপথ অবরোধ এবং সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ওই জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম, সিলেট, মাদারীপুর, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও মুন্সিগঞ্জ। এর মধ্যে কয়েকটি জেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর মধ্যে সংঘর্ষে আহতও হয়েছেন অনেক নেতা-কর্মী।

দলীয় নীতিনির্ধারকদের মতে, দলের অনেক সিনিয়র নেতার সন্তান, ভাই কিংবা স্ত্রীসহ মনোনয়নপ্রত্যাশী আত্মীয়স্বজনও এবার মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। ফলে তাদের ভিতরেও একটা চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। ঘোষিত সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় ৮৪ জন প্রার্থী একেবারেই নতুন। এর আগে তাঁরা সংসদ নির্বাচনে অংশ নেননি। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০ জন রয়েছেন, যাঁদের বাবা কিংবা মা এর আগে এমপি ছিলেন। এ ছাড়া দুইজনের স্বামী এমপি কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন। বিএনপির প্রার্থী তালিকায় চারজন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু আছেন। রয়েছেন ৯টি আসনে ১১ জন নারী প্রার্থীও।

শরিক দলগুলোর মধ্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫, এলডিপির চেয়ারম্যান ড. অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক চট্টগ্রাম-১৪, মহাসচিব ড. রেদওয়ান আহমদ কুমিল্লা-৭, জাতীয় পার্টি (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার পিরোজপুর-১, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের স্ত্রী তানিয়া রব লক্ষ্মীপুর-৪, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম লক্ষ্মীপুর-১, বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ ঢাকা-১৭, এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ঢাকা-১৩, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর পটুয়াখালী-৩ ও মহাসচিব রাশেদ খান ঝিনাইদহ-২, এনপিপি চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নড়াইল-২, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান ঝালকাঠি-১, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একাংশের জুনায়েদ আল হাবিব ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ এবং গণফোরাম ও গণঅধিকার পরিষদের রাজনীতি করার পর এখন কোনো দলে না থাকা ড. রেজা কিবরিয়া হবিগঞ্জ-১ আসনে জোটের মনোনয়ন আশা করছেন। এসব আসনে এখনো কারও নাম ঘোষণা করেনি বিএনপি। তবে উল্লেখিত আসনে জোটের প্রার্থীরা যে মনোনয়ন পাবেন, তা অনেকটাই নিশ্চিত।

এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষনেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বিএনপির সঙ্গেই তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছেন। আসন নিয়ে যুগপতের শরিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তিনি তাঁর নির্বাচনি এলাকা বগুড়া-২ আসনে ইতিমধ্যেই প্রচার-প্রচারণাও শুরু করেছেন বলে জানান।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি চলতি মাসেই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা হবে।

দলের একাধিক নীতিনির্ধারকের মতে, ঘোষিত ৬৩টি খালি আসনের বেশির ভাগই শরিক দলগুলোর জন্য ছাড় দেওয়া হতে পারে। এ নিয়ে প্রক্রিয়া চলছে। চলতি মাসেই গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে শরিক রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

এদিকে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনি মাঠে থাকার বিষয়ে বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশনা অমান্য করার অভিযোগ উঠেছে বেশ কয়েকটি আসনের সম্ভাব্য একক প্রার্থীর বিরুদ্ধে। তাঁরা নিজ এলাকার মনোনয়নবঞ্চিতদের সঙ্গে এখনো কথা বলেননি। এমনকি সহযোগিতা চেয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার বিষয়ে প্রার্থীরা মনোনয়নবঞ্চিতদের ফোন পর্যন্ত করেননি। ঘোষিত প্রার্থীদের এমন আচরণ বিভেদকে আরও উসকে দিচ্ছে বলে অনেকের ধারণা।

তবে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বলছেন, প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে দলের ভিতরে ক্ষোভ থাকলেও ঐক্য রক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিক্ষোভ ঠেকাতে বঞ্চিতদের পর্যায়ক্রমে ডেকে বোঝানো হচ্ছে। তাঁরা আশা করছেন, দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হবে।

জানা যায়, ঘোষিত ২৩৭ আসনের মধ্যে অন্তত অর্ধশত আসনে বিরোধ চলছে। এসব আসনের মনোনয়নবঞ্চিতরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, সম্ভাব্য একক প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে প্রার্থীর অবস্থান ও জনপ্রিয়তা সঠিকভাবে যাচাই করা হয়নি। যাঁরা জরিপে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাঁরা বিএনপির হাইকমান্ডকে ভুল তথ্য দিয়ে থাকতে পারেন। যে কারণে এই বৈরী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এসব আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও মনোনয়নবঞ্চিতদের একাধিক নেতা জানান, তাঁরা প্রতিদিনই মাঠে থাকছেন এবং ৩১ দফা ও ধানের শীষের প্রচারণা চালাচ্ছেন।

প্রার্থী পরিবর্তন প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দল আগেই বলেছে, এটা চূড়ান্ত নয়, সম্ভাব্য তালিকা। কোনো এলাকায় পরিবর্তন দরকার মনে করলে, অবশ্যই তা করা হবে। সবকিছু বিশ্লেষণ করেই তালিকা করা হয়। তিনি বলেন, মনোনয়ন ঘোষণার পর কিছু জায়গায় ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। কারণ অনেক জায়গাতেই মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য দুই-তিনজন করে নেতা আছেন। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলে ক্ষোভ মিটিয়ে নিচ্ছি।’

তবে পাল্টা চিত্রও দেখা গেছে। ঘোষিত অনেক আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী আবার দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনা মেনে নির্বাচনি কাজ করছেন। প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরপরই তাঁরা মনোনয়নবঞ্চিতদের বাসায় গিয়ে দেখাও করেছেন। ধানের শীষের প্রচারণাসহ দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমেছেন।