প্রতি বছর সারা দেশে চুরি হচ্ছে ২ লাখ মোবাইল ফোন সেট। একটির দাম গড়ে ৫ হাজার টাকা হলে বছরে চুরি হচ্ছে ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন টাকার মোবাইল ফোন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দেওয়া ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ চুরি হওয়া সব ফোনের ব্যবহারকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যান না। নানামুখী ঝামেলা এড়াতে তারা ফোন চুরির অভিযোগ করেন না। যারা চুরির অভিযোগ করেন তাদের বেশির ভাগই ফোন পাচ্ছেন না। কারণ চুরির সঙ্গে সঙ্গে সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে ফোন। এরপর দ্রুতগতিতে ফোনের যন্ত্রাংশ খুলে ফেলা হয়। পরে সেসব যন্ত্রাংশ বিক্রি করা হয় দেশের বিভিন্ন মোবাইল মেরামতকারী ব্যবসায়ীদের কাছে। অন্যদিকে প্রশাসনের তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপে অনেক সময় চুরি হওয়া ফোন দ্রুতগতিতে উদ্ধার করার ঘটনাও রয়েছে। রাজধানী ঢাকাতে এ ধরনের উদাহরণ সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে বিটিআরসি। চুরি হওয়া ফোন যদি কেউ ব্যবহার করেন সেক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেটা উদ্ধার করতে পারেন। যন্ত্রাংশ খুলে ফেললে বা বিদেশে পাচার করা হলে সেই ফোন উদ্ধার করা সম্ভব না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, চুরি করা ফোন বিদেশে পাচার করার জন্য রাজধানীতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। তাদের হাতে চোরাই ফোন গেলে সেটা যদি দামি হয় তাহলে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পাচার করা হয়। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সেখানে বিক্রি হয় কম দামে। একই ঘটনা ভারতের ক্ষেত্রেও। ওই দেশে চুরি হওয়া অনেক ফোন বিক্রি হয় আমাদের দেশের বাজারে। এর বাইরে খোয়া যাওয়া দামি মোবাইল ফোন চলে যাচ্ছে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে।
এ প্রসঙ্গে গাজীপুর পুবাইল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম আমিরুল ইসলাম (বর্তমানে ডিএমপিতে কর্মরত) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুলিশের কাছে দেওয়া অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৫০ শতাংশের মতো চুরি হওয়া ফোন উদ্ধার করা সম্ভব হয়। আবার কিছু প্রতারক চক্র আছে যারা মোবাইল হ্যান্ডসেটের আইএমইআই পরিবর্তন করে। তখন সেটা উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে দামি ফোনগুলোর ক্ষেত্রে তারা দ্রুত পার্টস খুলে বিক্রি করে দেয়। তিনি জানান, প্রতিটি থানায় মাসে গড়ে ১৫ থেকে ২০টি ফোন চুরির অভিযোগ জমা পড়ে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ জমা হয় রাজধানীর থানাগুলোতে। পুলিশ বলছে, মোবাইল ছিনতাই, চুরি বা হারানো গেলে সেই মোবাইলে থাকা সবকিছু চলে যায় অপরাধীর হাতে, যা দিয়ে দুর্বৃত্তরা ভুক্তভোগীকে ব্ল্যাকমেল করে। একটি চক্র চোরাই মোবাইলের ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি নম্বর বা আইএমইআই নম্বর বদলে ফেলে বাজারে বিক্রি করে। আইএমইআই নম্বর বদল করায় হারানো মোবাইলের অবস্থান শনাক্ত করা যায় না। চক্রটি আইএমইআই নম্বর বদল করতে খুব দক্ষ। বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে ল্যাপটপের সঙ্গে সংযুক্ত করে মাত্র ৩ থেকে ৫ সেকেন্ডেই তারা আইএমইআই নম্বর বদলে ফেলে। সম্প্রতি রাজধানীতে এমন একটি চক্রের কয়েকজনকে আটক করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী মোবাইলের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করা অপরাধ।
মোবাইল হ্যান্ডসেট চুরি ও চোরাই মার্কেটের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছে বিটিআরসি। আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (এনইআইআর) চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। এর মাধ্যমে অবৈধভাবে আমদানিকৃত বা নিবন্ধনবিহীন ফোন দেশে ব্যবহার করা যাবে না। এই উদ্যোগের ফলে সরকারের হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় নিশ্চিত হবে এবং বাজারে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে এবং ভোক্তার অধিকার সুনিশ্চিত হবে বলে জানান তারা। এর সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমদানির পাশাপাশি বাংলাদেশে ২০১৭ সালে মোবাইল ফোন উৎপাদন শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে দেশিবিদেশি মিলে প্রায় ১৭টি মোবাইল ফোন কারখানা আছে দেশে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে, যেখানে প্রায় এক লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোন এখন কেবল স্থানীয় বাজারেই নয়, ভবিষ্যতে বিদেশেও রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি করছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য নতুন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। মোবাইল ফোন উৎপাদন ঘিরে দেশে আধুনিক প্যাকেজিং, প্রিন্টিং, ব্যাটারি, চার্জার, হেডফোন, ডাটা কেবলসহ আরও অনেক ধরনের কম্পোনেন্টের শিল্প গড়ে উঠেছে, যেখানে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং আরও প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ কাজ করছে।
এ প্রসঙ্গে মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইওবি) এর প্রেসিডেন্ট জাকারিয়া শহীদ জানান, দীর্ঘদিন ধরে বৈধ শিল্পের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অবৈধ বা গ্রে হ্যান্ডসেটের প্রবেশ ও ব্যবহার। দেশের মোট মোবাইল বাজারের প্রায় ৬০ শতাংশ এখন এই অবৈধ মার্কেটের দখলে।
এর ফলে বৈধভাবে ব্যবসা করা কোম্পানিগুলোর হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এবং সরকার বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতার পাশাপাশি বাজার চোরাকারবারিদের হাতে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া অবৈধ ফোন দিয়ে আর্থিক প্রতারণাসহ অনেক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, যার প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করা যায় না।