বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যম বিজ্ঞাপননির্ভর। সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশনের আয়ের প্রধান উৎস বিজ্ঞাপন। কিন্তু গত দেড় বছরে কমবেশি সব গণমাধ্যম সংকটে পড়েছে। বিজ্ঞাপন কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক বছরে গণমাধ্যমগুলোতে গড়ে বিজ্ঞাপন কমেছে ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক বিজ্ঞাপন কম পাওয়া যাচ্ছে। এর একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত এ সময়ে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বেসরকারি খাত সংকটে। তারা প্রতিষ্ঠান চালাতেই হিমশিম খাচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রচারে ব্যয় এক ধরনের অপচয় মনে করে এখন বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ রেখেছে।
দ্বিতীয়ত সরকারের বিজ্ঞাপন কমেছে প্রায় ৫৭ শতাংশ। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এখন সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার প্রায় বন্ধ রেখেছে। জরুরি এবং কিছু দিবস পালন ছাড়া বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ রেখেছে সরকার। দিবসভিত্তিক ক্রোড়পত্র প্রকাশের ক্ষেত্রেও সরকার ব্যয়সংকোচ নীতি গ্রহণ করেছে। বিজ্ঞাপনের দুর্ভিক্ষ গ্রাস করেছে ক্রীড়াঙ্গনও। বিসিবি পুরুষ দলের হোম সিরিজের ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী মিডিয়া স্বত্বের দরপত্র প্রক্রিয়ায় বোর্ডকে সহায়তা করার জন্য পরামর্শক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ইওআই আহ্বান করেছিল, কিন্তু কোনো আগ্রহ পায়নি। এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিসিবি তাদের মিডিয়া স্বত্বের মূল্যায়ন পেতে ইওআই এবং দরপত্র প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শক সংস্থা নিয়োগের চেষ্টা করছে, কিন্তু কেউ আগ্রহ দেখায়নি।’
তবে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিজ্ঞাপন উদ্বেগজনক হারে কমে যাওয়ার একমাত্র কারণ অর্থনৈতিক সংকট নয়, চাঁদাবাজি। নীরব চাঁদাবাজির কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিতে ভয় পাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আমরা একটি নতুন প্রোডাক্ট চালু করেছি সম্প্রতি। সে উপলক্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। বিজ্ঞাপন প্রচারের কয়েক দিনের মধ্যেই ছাত্র পরিচয় দিয়ে কয়েক তরুণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আসে। তারা একটি অনুষ্ঠানের জন্য ব্যাংকের কাছে স্পন্সর চায়। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে এভাবে স্পন্সর দেওয়া সম্ভব নয়। তারা রীতিমতো হুমকি দিতে থাকে।’ ওই ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও জানান, ‘এটাই শেষ নয়, এর পর থেকে একের পর এক আসতে থাকে নানান ধরনের লোকজন। বাধ্য হয়ে আমরা এখন বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ রেখেছি।’ তাঁর মতে ‘এতে প্রোডাক্টের ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।’
নতুন আইফোন বাংলাদেশের বাজারে নিয়ে এসে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিপাকে পড়েন এক মাঝারি ব্যবসায়ী। তাঁর আউটলেট থেকে ফোনসেট বিনামূল্যে নিতে যোগাযোগ করেন অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি। এ রকম ঘটনা ঘটছে সর্বত্র। একজন শিল্পোদ্যোক্তা বললেন, নতুন পণ্য বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা আপাতত বন্ধ রেখেছেন। কারণ হিসেবে বলেন, নতুন পণ্য বাজারে নামালেই বিজ্ঞাপন দিতে হবে। আর বিজ্ঞাপন দিলেই শুরু হবে চাঁদাবাজি। একজন ব্যবসায়ী বলছিলেন, ইদানীং একটি ছোট এবং মাঝারি বেসরকারি অফিসে চাঁদাবাজির উৎপাত বেড়েছে। হঠাৎ করেই ১৫-২০ জন তরুণ চলে আসছে অফিসে। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের কথা বলে চাঁদা দাবি করছে। না দিলে মামলার হুমকি দিচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বিজ্ঞাপন দূরের কথা, অনেক ছোট অফিস তাদের সাইনবোর্ড নামিয়ে নিয়েছে। কেউ কেউ আবার তাদের ওয়েবসাইট বন্ধ করে রেখেছে। একজন আইটি ব্যবসায়ী বলছিলেন, ‘ফুটপাতের চাঁদাবাজি কিংবা বাজার-হাটে চাঁদাবাজির কথা আমরা সবাই জানি। এসব নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখিও হয় বিস্তর। কিন্তু আমাদের মতো ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে চাঁদাবাজির কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম, তা নিয়ে কথা বলার কেউ নেই।’ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত এক বছরে আইটি ফার্ম, ট্রাভেল এজেন্সি, বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান চাঁদাবাজির কারণে হয় গুটিয়ে নিয়েছে, অথবা বন্ধ হয়ে গেছে।
এ ধরনের ঘটনা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করে লাভের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশি। নতুন করে শুরু হয় হয়রানি।